উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলিকে ছাপিয়ে যাচ্ছে ভারতের শ্রম ‘সংস্কার’
ভারতের প্রথম সারির গণমাধ্যমগুলির মধ্যে অনেকগুলিই আইনের শাসন ও ব্যক্তি স্বাধীনতা নিয়ে সরব। হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের জমানায় সেটা ভালোই। কিন্তু দেখলে অবাক লাগে, সেই সব গণমাধ্যমগুলিই শ্রমিকদের অধিকারের ওপর ক্রমাগত আক্রমণ নিয়ে একেবারেই নীরব। অথচ আমরা জানি, তিনশ বছর ধরে নিরন্তর সংগ্রাম ও অকল্পনীয় আত্মত্যাগের মধ্যে দিয়েই সেগুলো অর্জন করা গেছে।
ভারত সহ গোটা দুনিয়ার শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাস মানেই ছাঁটাই, শ্রমিকদের জেলে পোরা, পুলিশের গুলিতে শ্রমিক ও নেতাদের মৃত্যুর ইতিহাস। তাই যখন ধনী ও স্বচ্ছল লোকজন বলে, শ্রমিকদের উচিত দেশের প্রয়োজনের জন্য নিজেদের দাবিগুলো কম করা, তখন রাগ-বিরক্তি হয় বৈকি!
বর্তমানে ‘আর্থিক সংস্কারে’র নামে আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডার-বিশ্ব ব্যাঙ্ক ভারতের ওপর ‘কাঠামোগত সমন্বয়’ চাপিয়ে দিচ্ছে। আর দেশের রাজনৈতিক নেতারা তা বিনা বাক্যব্যয়ে মেনেও নিচ্ছে। এইসব শব্দগুলোর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বৃহৎ পুঁজিপতিরা ভারতের যেটুকু আর্থিক সার্বভৌমত্ব ও এ দেশের জনগণের জন্য যেটুকু সামাজিক-অর্থনৈতিক সুরক্ষা ছিল, সেগুলো কেড়ে নিচ্ছে।
বিনিয়োগ ও পরিচালন ব্যবস্থায় যেটুকু বিধিনিষেধ ছিল, সেগুলো শিথিল করা চলছে এবং কর্পোরেটরা মুনাফার জন্য কোনো বিধিনিষেধের তোয়াক্কা করছে না। বিনিয়োগ ও মুনাফার সঙ্গে প্রকৃত পণ্য উৎপাদনকে মিশিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ব্যাঙ্ক থেকে জনগণের সঞ্চিত অর্থ যেভাবে বেরিয়ে যাচ্ছে, তার থেকে বোঝা যায়, কীভাবে ‘সহজে ব্যবসা করার’ নামে কর্পোরেটরা বিনা নজরদারিতে লুঠপাট চালাচ্ছে।
নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য আজ বিশ্ব বাজারের পণ্য। সেই বাজারের স্বার্থ অনুযায়ী সেগুলি পাওয়া যায় বা যায় না। তাই কোটি কোটি গরিব মানুষের পক্ষে ‘আয়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ব্যয়’ করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শ্রম আইনে ‘সংস্কার’ হল জনগণের অধিকারের কফিনে শেষ পেরেক। এই ধরনের বিলগুলি সরকার সংসদে বি্না বাধায় পাস করিয়ে নিতে পারছে। আটকানো তো চিরকালই অসম্ভব ছিল কিন্তু এখন বিন্দুমাত্র বিরোধিতাও হচ্ছে না। কারণ যতদিন যাচ্ছে, সংসদে কোটিপতির সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিও মোটেই ভালো নয়। সোভিয়েত বিপ্লবের ২ বছর পর জেনেভায় আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠন(আইএলও) তৈরি হয়। লক্ষ্য ছিল, ক্রমেই বাড়তে থাকা জঙ্গি শ্রমিক আন্দোলন ও তার প্রভাবকে ঠেকিয়ে রাখা। এই সংগঠনে শ্রমিক সংগঠন, বিভিন্ন দেশের সরকার ও পুঁজিপতিদের প্রতিনিধিরা থাকেন। ফলে শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে এরা কতটা কী করতে পারে, তা নিয়ে সন্দেহ থাকলেও আইএলও দুনিয়া জুড়ে শ্রম আইন কেমন হওয়া দরকার, সে সম্পর্কে কিছু পরামর্শ দিয়ে এসেছে বহুদিন ধরেই। সেগুলি মানতে কোনো দেশ বাধ্য না হলেও, তার নৈতিক প্রভাব রয়েছে। এগুলি শ্রমজীবী মানুষের নিরাপত্তা ও কল্যাণে কিছু ভূমিকা পালনও করেছে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আন্তর্জাতিক শ্রম মান অনুযায়ী উপযুক্ত কারণ ছাড়া কোনো শ্রমিককে কাজ থেকে ছাঁটাই করা চলবে না এবং অন্যায্য অভিযোগের বিরুদ্ধে তাঁকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে। বর্তমানের শ্রম সংস্কার, পুঁজির সর্বাত্মক নিয়ন্ত্রণ কায়েম করার লক্ষ্যে এই সমস্ত বাধা দৃর করতে চাইছে।
আইএলও বর্তমানে সম্পূর্ণ ভাবে সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির প্রভাবাধীন। যদিও একের পর এক ছাড় দিয়ে চললেও তারা সম্পূর্ণ ভাবে নতিস্বীকার এখনও করেনি। কিন্তু ভারত সরকার এখন যে শ্রম ‘সংস্কার’গুলো করছে, সেগুলোর প্রস্তাব আইএলও দেয়নি, দিয়েছে বিশ্ব পুঁজির দুই সংগঠন আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডার ও বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা। তাদের পরিচালন বোর্ডে কোনো শ্রমিক প্রতিনিধি নেই।
‘শ্রম আইন নমনীয়’ করার জন্য আজকাল কান্নাকাটির শেষ নেই, অথচ দেখা হচ্ছে না যে এই নমনীয়তা কেবলমাত্র পুঁজির স্বার্থে। আইনে বলা হচ্ছে, কোনো সংস্থার কর্মীদের ৭৫ শতাংশ যদি সংশ্লিষ্ট ট্রেড ইউনিয়নের সদস্য হয়, তবেই সেটা স্বীকৃতি পাবে। এই আইনের যুক্তি কী? শ্রমিকদের সংগঠিত হওয়ার অধিকার একটি সাংবিধানিক অধিকার। দীর্ঘদিনের কঠিন লড়াই ও আত্মত্যাগের মধ্যে দিয়ে তা অর্জন করা গেছে। ট্রেড ইউনিয়নের কাজ শ্রমিকদের হয়ে সংগঠিত ভাবে মালিকপক্ষের সঙ্গে দরাদরি করা। কোনো ট্রেড ইউনিয়নের সদস্য সংখ্যা যদি শ্রমিকদের ৬৬ শতাংশ বা ৫০ শতাংশ হয়, তাহলে কেন তা স্বীকৃতি পাবে না!! যদি কোনো ইউনিয়নের সদস্য সংখ্যাই কারখানার মোট শ্রমিকের ৭৫ শতাংশ না হয়, কিন্তু যদি ইউনিয়নগুলি যৌথ ভাবে সেই সংখ্যার প্রতিনিধিত্ব করে, তাহলে কী হবে? সেক্ষেত্রেও কী তাদের দরাদরির সুযোগ দেওয়া হবে না?
আরেকটি বিষয় হল, চাকরির নিরাপত্তা। ‘পুঁজিবাদী স্বর্গরাজ্যে’ সকলের সমান অধিকার। সেই অধিকার অনুযায়ী, মালিক বা শ্রমিক যে কেউ যে কোনো সময় নিজেদের প্রয়োজন ও সুবিধা অনুযায়ী চুক্তি ভেঙে দিতে পারে। কিন্তু বাস্তবের মাটি সম্পূর্ণ আলাদা। সেখানে মালিকপক্ষের লোভ এবং মুনাফা বাড়ানোর জন্য খরচ কমানোর ধান্দা এবং সেজন্য ছাঁটাই শ্রমিকদের কাছে দুঃস্বপ্ন। তাই চাকরির নিরাপত্তা একটি জরুই বিষয়। কম সময়ের চাকরির ক্ষেত্রেও পর্যাপ্ত বেতন এবং একটি নির্দিষ্ট মেয়াদ থাকা দরকার, যাতে পরবর্তী কাজটি না পাওয়া পর্যন্ত শ্রমিকদের জীবনধারণে অসুবিধা না হয়। যদিও এসব কোনোটাই স্থায়ী চাকরির বিকল্প নয়। সেটিই আদর্শ। তবু বেসরকারি পুঁজি নির্ভর দুনিয়ায় এই আইনগুলো প্রয়োজনীয়।
ভারতের নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে, ৯০ শতাংশ কাজই রয়েছে অসংগঠিত ক্ষেত্রে। মোট শ্রমশক্তির ৩.৮০ শতাংশ কাজ করেন রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রে। অথচ ভারতের সংগঠিত শ্রমিকদের ৬৯ শতাংশই রয়েছেন সেখানে। কিছু তুলমামূলক তথ্য দেওয়া যাক। ইউনাইটেড কিংডমের রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রে কাজ করেন ১৬.৫ শতাংশ শ্রমিক, ফ্রান্সে ২৮ শতাংশ, কানাডায় ২২.৪ শতাংশ, জার্মানিতে ১৫.৩ শতাংশ, ডেনমার্কে ৩২.৯ শতাংশ, নরওয়েতে ৩৫.৬ শতাংশ। অর্থাৎ আমাদের দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রে আরও অনেক মানুষকে নিয়োগ করার জায়গা আছে অথচ সরকার এই সংস্থাগুলিকে বেচে দিতে উঠেপড়ে লেগেছে।
জার্মানিতে চলতি বছরে যে নিয়োগ ও শ্রম আইন জারি হয়েছে, তাতে বলা হয়েছে সমস্ত নিয়োগের চুক্তিপত্রে সই থাকতেই হবে এমনকি সইহীন চুক্তিপত্রও আদালত গ্রাহ্য করতে পারে। চুক্তিতে নিয়োগের তারিখ, চাকরির মেয়াদ, ছুটির দিন, কাজের সময়কাল, কর্মীর পদ, বেতন, প্রাপ্য ছুটি, অসুস্থ থাকলে কত অর্থ পাবে- সব স্পষ্ট ভাবে লেখা থাকতেই হবে। শ্রমিকদের ইউনিয়ন তৈরির অধিকার একটি সাংবিধানিক অধিকার। যৌথ দরাদরি ব্যর্থ হলে ট্রেড ইউনিয়নগুলির ধর্মঘট করারও অধিকার রয়েছে। চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকদের স্থায়ী শ্রমিকদের থেকে আলাদা ভাবে দেখা বেআইনি। এমনকি সংস্থার মালিকানা পালটে গেলেও চুক্তির শর্ত পালটানো যাবে না। যে সব সংস্থায় ৫০০-র বেশি কর্মী আছে, সেখানে সংস্থার বোর্ডের প্রতিনিধিদের এক-তৃতীয়াংশ শ্রমিক হতে হবে। যদি কর্মী সংখ্যা ২০০০-এর বেশি হয়, তাহলে বোর্ডের অর্ধেক হবেন শ্রমিক।
সম্পূর্ণ ভাবে পুঁজিবাদী একটি দেশে এরকম শক্তিশালী শ্রম আইন রয়েছে, তাহলে আমাদের দেশে কেন শ্রম আইনকে দুর্বল করার দরকার পড়ছে?
১৯৯৮ সালে আইএলও-তে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়েছেল, যাতে বলা হয়- চুক্তি শ্রমিকদের স্থায়ী শ্রমিকদের থেকে আলাদা চোখে দেখা যাবে না। তাদেরও যৌথ ভাবে দরাদরির অধিকার থাকবে। কাজের বেতন ও কাজের সময় নির্দিষ্ট থাকবে। থাকবে বিধিবদ্ধ সামাজিক সুরক্ষাও। আমাদের দেশের প্রস্তাবিত ‘শ্রম আইন নমনীয়তা’ এই সব কিছু শেষ করে দিতে চাইছে।
আইএলও-র ১৫৮ নম্বর কনভেনশনে বলা আছে- ইউনিয়ন করার জন্য, কাজ শেষ হওয়ার পর অন্য কাজ করার জন্য, শ্রম আইন না মানলে নিয়োগকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করার জন্য কোনো শ্রমিককে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা যাবে না। কোনো শ্রমিকের আচরণে বড়ো রকমের সমস্যা হলে তবেই তাকে চাকরি থেকে সরানো যাবে। সেই আচরণটাও সুনির্দিষ্ট করতে হবে।
‘সংস্কার’-এর নামে আমাদের দেশে শ্রমিকদের এই সব সুরক্ষাগুলি কেড়ে নেওয়া হচ্ছে।
সূত্র: নিউসক্লিকে প্রকাশিত হিরেন গোঁহাইয়ের প্রবন্ধের অনুবাদ (কিছু পরিমার্জন সহ)