একটা ধর্ষণ। মহিলাদের নিরাপত্তা নিয়ে যখন সারা দেশ তোলপাড়, তখন চারটে হত্যা।
যাঁরা মারা গেলেন, আইনি পরিভাষায় তাদের বলে ‘অভিযুক্ত’। অর্থাৎ তদন্তকারী পুলিশের মনে হয়েছে এরাই অপরাধটা করেছে। কোর্টে সেই সব প্রমাণ খতিয়ে দেখেন বিচারক। প্রমাণের ভিত্তিতে বিচারক রায় দেন এবং অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী আইনের নির্দিষ্ট ধারা মেনে শাস্তি দেন।
সভ্য দেশে নিয়ম এটাই। বিচার ছাড়া হত্যার নাম খুন।
একটা অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিচার ব্যবস্থার অনেক ত্রুটি থাকলেও, সাধারণ মানুষ বিচার আর সুরক্ষার জন্য আদালতেরই দ্বারস্থ হয়।
চারজন নিরস্ত্র মানুষকে বিনা বিচারে হত্যা করা, সত্যিই কি এটাই বিচার! প্রশ্ন থেকে যায় এই ঘটনার পেছনে কোনো প্রভাবশালীর হাত নেই তো? নেই তো কোনো মন্ত্রী, আমলা, ব্যবসায়ী। ভারতের আইন তো তারাই চালায়। এই চারজন মানুষের জন্য কেউ বিচার চাইবে না। জানতে চাইবেনা এই ঘটনার রহস্যের কথা। একটা ড্রাইভার, খালাসি, সাফাই কর্মী মরেছে তো। ডাক্তার, উকিল, ইঞ্জিনিয়ার, মন্ত্রী বা ‘বাবু’ শ্রেণির কেউ মরেনি তো।
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে মব লিনচিং এখন সাধারণ ঘটনা। এবার সরকার চাইছে বিচারাধীন বন্দি হত্যাকে আইনি মোড়ক দিতে। যারা চারজন অভিযুক্তর ‘এনকাউন্টারের’ ঘটনা নিয়ে নৃত্য করছেন, তারা এই কালচারেরই অংশ। আমাদের বর্তমান সরকার এধরনের জনতারই প্রতিনিধিত্ব করে। সরকারের দালালরা সোশাল নেটওয়ার্কে-এ প্রচার চালিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করছে ‘এটাই সবাই চেয়েছে’। না মানুষ এটা চায়নি। মানুষ চেয়েছিল দ্রুত বিচার করে অপরাধীর শাস্তি। মানুষ চায়নি চারজন অভিযুক্তর হত্যা।
আর প্রিয়াঙ্কাদের বিচারও শেষ হয়ে গেল এই চারটে মানুষের হত্যার সঙ্গে সঙ্গে? আর কেউ প্রিয়াঙ্কার মৃত্যুর নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি জানবে না। রক্ত, হত্যা হয়ে গেছে আর বিচার লাগবে না।
নারীসুরক্ষা, লিঙ্গ সংবেদশীলতার বিষয়ে রাষ্ট্রের দায়ও শেষ। চারজন মানুষকে হত্যা করেই।
তবে শুধুমাত্র বিষয়টাকে ধামাচাপা দেওয়াই এ ক্ষেত্রে সরকারের উদ্দেশ্য নয়। ‘এনকাউণ্টারকে’ আইনি করে দেওয়াটাই রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য।। বিজেপি-আরএসএস এমন একটা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চাইছে যেখানে মানুষ তোয়াক্কা করেনা মানবাধিকারের, তোয়াক্কা করেনা তদন্ত বা বিচার ব্যবস্থার। এমন এক পুলিশ-মিলিটারি-রাজ সেখানে প্রতিবাদী কণ্ঠকে দমিয়ে দেওয়া আরো সহজ হয়ে উঠবে। কয়েকদিন আগেই পাশ হয়েছে নতুন আইন, যার বক্তব্য অনুযায়ী যেকোনো ব্যক্তিকে সন্ত্রাসবাদী সন্দেহে গ্রেফতার করতে পারে রাষ্ট্র। কাশ্মীরের অবস্থা প্রায় চার মাস ধরে জানা যাচ্ছে না। আর এভাবে এনকাউণ্টারকে মূলস্রোতে নিয়ে আসলে দুদিন পরে সন্ত্রাসবাদী সন্দেহে গ্রেফতার করা ব্যক্তিকে ফেক এনকাউন্টারে হত্যা করা হবে।
ধর্ষণ বিষয়টাকে সামনে রেখে আসলে এই পুলিশরাজ কায়েম করাই সরকারের প্রধান উদ্দেশ্য। সরকারও জানে তীব্র অর্থনৈতিক সংকট থেকে যে কোনো দিন বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠতে পারে। দেশের সম্পদ আম্বানি-আদানি ও বহুজাতিক সংস্থাকে বেচে দেওয়া সরকার ভেঙ্গে পড়তে পারে তাসের ঘরের মত। আসলে মানুষের বিদ্রোহকে দমন করার জন্য গড়ে তোলা হচ্ছে এক সংস্কৃতি।
‘এনকাউণ্টার’ আসলে মানুষের বিদ্রোহ দমন করার হাতিয়ার। যারা আজ একে বুঝে বা না বুঝে সমর্থন করছেন মনে রাখবেন সমাজের কোন ক্ষমতাশালী শক্তির সঙ্গে সঙ্ঘাত হলে এর বলি আপনিও হতে পারেন। নিজের ন্যায্য দাবি নিয়ে রাস্তায় নামলে পুলিশ আপনাকে গ্রেফতার করে ‘দেশদ্রোহী’ তকমা দিয়ে এনকাউণ্টার করে দিতে পারে।
এবং করে চলেছে। আজ ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে দেশদ্রোহী তকমা দিয়ে বহু মানুষকে জেলে পোরা হয়েছে। এনকাউণ্টার করে খতম করা চলছে। মানুষ এসবের হয়তো খবর রাখতেন না। হায়দরাবাদের ঘটনায় ‘এনকাউণ্টার’ করে রাষ্ট্র আসলে চাইছে সব ‘এনকাউণ্টার’কে ন্যায্যতা দিতে।
রাজনৈতিক কর্মীদের এনকাউন্টারের মাধ্যমে হত্যা করা রাষ্ট্রের কাছে নতুন নয়। অধিকারের দাবিতে আন্দোলনকে দমিয়ে দিতে ভুয়ো সংঘর্ষ রাষ্ট্রের কাছে অন্যতম হাতিয়ার।
গত পাঁচ বছরে শুধুমাত্র নকশালযোগে তেলেঙ্গানা পুলিশ প্রায় ৫-৬টি এনকাউন্টার করেছে, যা নিয়ে উঠছে প্রশ্ন, থেকে যাচ্ছে সন্দেহ।
২০১৫ সালে ভিকারুদ্দিন আহমেদ এবং আরো চারজনকে সংঘর্ষে হত্যা করে পুলিশ। তবে এনকাউন্টারের পর ভিকারুদ্দিনকে হাতে হাতকড়া, চেন দিয়ে বাধা অবস্থায় পাওয়া যায়। প্রশ্ন ওঠে এ রকম অবস্থায় সে কিভাবে পালানোর চেষ্টা করল এবং পুলিশকে আক্রমণ করল।
অন্যান্য কেসগুলি থেকেও উঠে আসা প্রমাণ ইঙ্গিত করে ভুয়ো সংঘর্ষের। এরকম উদাহরণ ইঙ্গিত করছে তেলেঙ্গানা পুলিশের সংঘর্ষের নামে বিনা বিচারে অভিযুক্তদের হত্যা করার প্রবণতা।
২০১২ সালে ছত্তীসগঢ় পুলিশ সার্কেগুদা গ্রামে মাওবাদী সন্দেহে সতেরো জন গ্রামবাসীকে হত্যা করে। কয়েকদিন আগে উঠে আসা রিপোর্ট থেকে জানা যায় তাদের মাওবাদী হওয়ার কোনো প্রমাণ ছিল না। অর্থাৎ ১৭জন নিরস্ত্র মানুষকে বিনা বিচারে হত্যা করে পুলিশ।
এ কথা বলার অর্থ এই নয় যে মাওবাদী হলেই ভুয়ো সংঘর্ষে গুলি করে মেরে দেওয়ার বৈধতা থাকে। কিন্তু যেহেতু মাওবাদীরা সশস্ত্র রাজনীতি করে, তাই ‘সংঘর্ষে’ মৃত্যুর একটা সম্ভাবনা থেকেই যায়। সেই সুযোগ নিয়ে বহু ভুয়ো সংঘর্ষের ঘটনা রাষ্ট্র ঘটায়। কিন্তু ধর্ষণ বা অন্যান্য অপরাধের ক্ষেত্রে স্রেফ গ্যালারি শো করার জন্য হত্যা তুলনামূলক ভাবে এক নতুন প্রবণতা। যা প্রশাসন নিজের অকর্মণ্যতা থেকে জনগণের চোখ সরিয়ে নিতে ব্যবহার করছে।
খুব দেরি হওয়ার আগে আওয়াজ তুলুন এই পুলিশরাজের বিরুদ্ধে, আওয়াজ তুলুন নারীসুরক্ষা শুধু নয়, নারীমর্যাদার জন্য। আওয়াজ তুলুন এক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য।