

‘… সেই রাতেই বাল্টিক নৌ-বহরের নাবিকরা বিদ্রোহ করবে।বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়বে মস্কো গ্যারিসনে। হাজার হাজার শ্রমিক রাতের বরফকে পায়ে পিষে লাল পতাকা নিয়ে বেরিয়ে আসবে। ক্রেমলিনের দেওয়ালে ধাক্কা খাবে ঝড়ের শ্লোগান।সেন্ট পিটার্সবার্গ আবার লেনিনগ্রাদ।
সেই রাতেই ইন্দোনেশিয়ার কমিউনিস্টরা, আর বিনা বন্দুকে নয়, অভ্যুত্থান ঘটাবে। অস্ট্রেলিয়ায় একের পর বন্দরে ছড়িয়ে পড়বে ধর্মঘট। বলিভিয়ায় ফেটে পড়বে টিন শ্রমিকদের বিক্ষোভ-লেনিন ও চে-র ছবি নিয়ে লাতিন আমেরিকার প্রত্যেকটা রাজধানী অচল করে দেবে ছাত্র ও মধ্যবিত্ত মানুষ। শ্রমিক ধর্মঘটে অচল হয়ে যাবে ফ্রান্স, ইতালি, গ্রিস, স্পেন…খবর আসবে আফ্রিকা থেকে, আরব দুনিয়া…’(পৃথিবীর শেষ কমিউনিস্ট, নবারুণ ভট্টাচার্য)

না। এখনও ততটা হয়নি। তবে দিন সাতেক আগে কানাডার রেল শ্রমিকদের ধর্মঘট চলল আটদিন। তার জেরে জ্বালানি না পেয়ে বিক্ষোভে নেমে পড়লেন কৃষকরা, ট্রেন না আসায় খনিতে কাজ বন্ধ হয়ে গেল, ভ্যাঙ্কুভার বন্দরে মাল না আসায় বাড়তি ভাড়া গুনতে হচ্ছিল নৌকা-মালিকদের, পুঁজিবাদী অর্থনীতির শৃঙ্খল ভেঙে পড়ার অবস্থা তৈরি হয়েছিল। তারপরই ভ্যাঙ্কুভারের পরিবহণ শ্রমিকরা নতুন চুক্তির দাবিতে তিনদিন ধর্মঘট ডেকেছিল, সরকার কোনোমতে সেটা থামায়। যে কোনো বিপ্লবের আগে এরকম ঘটনা বেশ কয়েকবার ঘটে, আমরা তো ইতিহাস থেকেই জানি।তারপর শৃঙ্খল ভেঙে পড়ে। আপাত শান্ত উন্নত পুঁজিবাদী দেশ কানাডার এমন ঘটনায় চমকে গিয়েছেন অনেকেই। তারা ১৩ সেপ্টেম্বর ফ্রান্সের শ্রমিকদের সর্বাত্মক ধর্মঘটেও হয়তো ততটা চমকাননি। সেখানে বিপ্লবী সংকট চলছে এমনটা কেউ কেউ মনে করলেও আমল না দেওয়ার লোকও কম নেই। যদিও ৫ ডিসেম্বর থেকে ফ্রান্সের শ্রমিকরা অনির্দিষ্ট ধর্মঘটের ডাক দিয়েছেন। নতুন বছর পর্যন্ত ‘ছবির দেশ, কবিতার দেশ’ স্তব্ধ হয়ে থাকে, তাহলে গোটা দুনিয়া যে সেদিকেই তাকিয়ে থাকবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

এই মুহূর্তে অবশ্য নজরের কেন্দ্রে এশিয়া, আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকা। মাও সেতুং বলেছিলেন,মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ সবচেয়ে বেশি ভয় পায় এই তিন মহাদেশের মানুষের জাগরণ। এই তিন মহাদেশের মানুষের কাজ হল একজোট হয়ে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ যেখান থেকে এসেছে, সেখানে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া। ঠিক ষাট বছর আগে বলা কথাগুলো আজ যেন মানুষ নতুন করে শুনতে পাচ্ছে। অসাম্য, দুর্নীতি ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার জন্য একসঙ্গে লড়তে শুরু করেছে দুনিয়ার জনগণ।মিশর থেকে শুরু হয়ে তা একে একে ছড়িয়ে পড়েছে ইরাক, লেবানন, ইকুয়েডর, হাইতি, চিলি, কলোম্বিয়ায়। মাও বলেছিলেন ‘পূবের হাওয়া পশ্চিমে বইছে’। সেই কথারই প্রতিধ্বনি আমরা শুনতে পাই, যখন স্পেনের ক্যাতালোনিয়ার স্বাধীনতাকামী যুবক পুলিশের উদ্দেশ্য বলে ওঠে, ‘আমরা এখানে হংকং তৈরি করে দেবো’। এমনকি, শুধু ইসলামি মৌলবাদীদের জন্য বারবার নজর কেড়ে নেওয়া আমাদের পাশের দেশ পাকিস্তানে দুদিন আগে দেশ জুড়ে লাল পতাকা নিয়ে মিছিল করেছে ছাত্রছাত্রীরা।

জনগণ লড়ছেন, বিক্ষোভের নিত্যনতুন পথ খুঁজে বের করছেন, অবলীলায় প্রাণ দিচ্ছেন। চিলি, ইরাক, লেবানন- সর্বত্রই একই ছবি। কেন লড়াই করে মানুষ? কেন প্রাণ দেয় প্রবল প্রতাপশালী শত্রুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে? কারণ তাঁরা দুনিয়াটা তাঁদের নিজেদের বাসযোগ্য করে তুলতে চায়। শোষণ-নিপীড়ন-প্রতিদিন যাপনের প্রাণ ধারণের গ্লানি থেকে মুক্তি চায়। নিজেদের জীবন থেকে তারা উপলব্ধি করে, এই ব্যবস্থাগুলো তাদের সমস্যার সমাধান করতে পারবে না।স্বতস্ফূর্ততা থাকে নিশ্চয়। অনেকে জনবিক্ষোভের আড়ালে একাধিক সাম্রাজ্যবাদী শক্তির লড়াইয়ের রহস্যও খুঁজে পান। মিথ্যে নয় তা। আমেরিকা বনাম চিন, আমেরিকা বনাম রাশিয়ার দুনিয়া দখলের লড়াই নিশ্চয় এই সব গণবিক্ষোভে প্রভাব ফেলছে। কিন্তু সেটা নেহাতই বাইরের শর্ত। দশ বছরেরও বেশি সময় ধরে আর্থিক মন্দায় ডুবে থাকা সাম্রাজ্যবাদ পথ হাতরাচ্ছে। এতদিন যে ছিটেফোঁটা সামাজিক সুরক্ষা তারা জনগণকে দিয়ে আসছিল নিজেদের টিকে থাকার স্বার্থে, আজ আর সেটা পারছে না। আমরা তো জানি, সাম্রাজ্যবাদ মানেই যুদ্ধ। ছোটো ছোটো অসংখ্য যুদ্ধ তারা চালিয়ে গেলেও বিশ্বযুদ্ধকে এড়াতে চাইছিল প্রাণপনে। আজ সে অবস্থা নেই। আমেরিকা আর অধঃপতিত চিনের বাজার দখলের লড়াই চূড়ান্ত জায়গায় পৌঁছেছে। বিশ্বযুদ্ধের বিপদ বাড়ছে। কিন্তু তা রুখতে পারেন কেবল জনগণ। আবার মাওয়ের কথাই স্মরণ করতে হয়, ‘হয় বিপ্লব বিশ্বযুদ্ধকে ঠেকাবে নইলে বিশ্বযুদ্ধ বিপ্লব ডেকে আনবে’। আজকের এই চলমান চলমান গণবিক্ষোভ বিশ্বযুদ্ধকে ঠেকানোর কাজ করছে। এই লড়াই যত তীব্র হবে তত সাম্রাজ্যবাদীরা পরাজয়ের পথে হাঁটবে। আর যদি তারা গোয়ার্তুমি করে বড়ো যুদ্ধ বাধায়, তাহলে গোটা দুনিয়াই মুক্ত হবে।

মনে রাখা দরকার, আজকের দুনিয়া অনেকটা সোভিয়েত বিপ্লবের আগের সময়ের মতো। চিন সমাজতন্ত্রের পথ থেকে সরে আসার পর এখন পৃথিবীতে কোনো সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র নেই। কিন্তু রয়েছে কমিউনিস্ট পার্টিগুলি আর তাদের শতবর্ষের অভিজ্ঞতা। বার্লিন দেওয়াল ভেঙে যাওয়ার পর মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের তীব্র আগ্রাসনে পিছু হঠেছিল দুনিয়ার প্রলেতারিয়েত। পথ খুঁজছিল বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টিগুলি। গত তিরিশ বছরে তারা নানা পরীক্ষানিরীক্ষা করেছে। অনেকগুলি মার্কসবাদী-লেনিনবাদী পার্টি, মাওবাদী পার্টিতে পরিণত হয়েছে। তৃতীয় বিশ্ব থেকে ইউরোপ, আমেরিকা- সর্বত্র ঘটেছে এই ঘটনা। কানাডা সহ বেশ কিছু দেশে বিপ্লবী পার্টিরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। নিজেদের মধ্যে লড়াইও চালিয়েছে। আর এসবই করতে গিয়ে তারা জনগণের মধ্যে গেছে। তার ফল মিলতে শুরু করেছে।

লাতিন আমেরিকার মাওবাদী পার্টিগুলো এক যৌথ বিবৃতিতে দাবি করেছেন, আজকের লড়াইয়ে তারা সামনের সারিতে রয়েছেন। লড়াইগুলোকে জঙ্গি রূপ দিচ্ছেন এবং সশস্ত্র লড়াইয়ের জন্য ক্যাডার সংগ্রহ করছেন।অন্য দেশগুলোর কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর নির্দিষ্ট বক্তব্য এখনও জানা না গেলেও আমরা জানি ‘জনগণই ইতিহাসের চালিকাশক্তি’। আর সমস্ত স্বতস্ফূর্ততার আড়ালেই থাকে বহুদিনের নীরব, ধৈর্যশীল, কঠিন প্রস্তুতি আর আত্মত্যাগের ইতিহাস। সেই ইতিহাস সামনে আসে অনেক পরে।আর সেই সবের সঙ্গেই যুক্ত থেকে যান দুনিয়ার শ্রমজীবীরা।পাকিস্তানের ছাত্রযুবরা গত ২৯ নভেম্বর যখন ‘কমিউনিস্ট এশিয়া’ তৈরির শ্লোগান দিচ্ছিলেন, তখন নতুন করে জিতে যাচ্ছিল সর্বহারার আন্তর্জাতিকতাবাদ। বাকি ইতিহাস তো লেখা হবে জল, জঙ্গল, জমি আর পথের লড়াইতে। কমিউনিজমের তৃতীয় ঢেউ শুরু হয়ে গেছে। ‘একটু পা চালিয়ে কমরেড’।