এনআরসি, এনপিআর, সিএবি আসলে কী?
এটা জানতে গেলে প্রথমেই আমাদের বুঝে নিতে হবে নাগরিকত্বের সংজ্ঞা আসলে কী? একজন নাগরিকের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্কের ভিত্তি মূলত তিন ধরনের অধিকার- সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক। প্রত্যেক নাগরিকের এই তিন ধরনের অধিকার সুনিশ্চিত করাই রাষ্ট্রের প্রধান কর্তব্য। ভারতের সংবিধান প্রত্যেক নাগরিকের ছয়টি মৌলিক অধিকার সুনিশ্চিত করে। সেগুলি হল-
১) সাম্যের অধিকার (১৪ থেকে ১৮ নম্বর অনুচ্ছেদ)
২) স্বাধীনতার অধিকার (১৯ থেকে ২২ নম্বর অনুচ্ছেদ)
৩) শোষণের বিরুদ্ধে অধিকার (২৩ ও ২৪ নম্বর অনুচ্ছেদ)
৪) ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার (২৫ থেকে ২৮ নম্বর অনুচ্ছেদ)
৫) সংস্কৃতি ও শিক্ষা বিষয়ক অধিকার (২৯ ও ৩০ নম্বর অনুচ্ছেদ)
৬) সংবিধানের প্রতিবিধানের অধিকার (৩২ ও ২২৬ নম্বর অনুচ্ছেদ)
দেখুন: শ্রমজীবী মানুষকে দাস বানাতেই এনআরসি করতে চায় রাষ্ট্র: লেখক ও চিত্র পরিচালক পার্থপ্রতিম মৈত্র
স্বাধীন ভারতে বিভিন্ন গণ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ধাপে ধাপে আরও বেশ কিছু অধিকার মানুষ আদায় করে নিয়েছে যেমন শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের অধিকার। খাদ্য সুরক্ষার অধিকার, অরণ্যের অধিকার ইত্যাদি।
কিন্তু বিগত সাড়ে পাঁচ বছরে মোদি সরকার বহু সংগ্রামে অর্জিত এই অধিকারগুলোকে আমাদের থেকে এক এক করে কেড়ে নিতে শুরু করেছে। এদের একটাই উদ্দেশ্য- সমস্ত দেশজুড়ে এক ধর্ম-এক ভাষা-এক শাসকের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করা। যারাই এই ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে সরব হয়েছেন, তাদের ওপরেই লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে দেশদ্রোহীর তকমা। নির্বাচন কমিশন, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক, সিবিআই, ইডির মতো স্বশাসিত সংস্থাগুলির স্বাধীনতা সম্পূর্ণ ভাবে ভূলুণ্ঠিত। এমনকি যে বিচার ব্যবস্থা ছিল সাধারণ মানুষের শেষ ভরসার জায়গা, তার নিরপেক্ষতাও ক্রমাগত প্রশ্নের মুখোমুখি হচ্ছে। একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ মামলায় সুপ্রিম কোর্টের ভূমিকা প্রাকৃতিক ন্যায়বিচারের মৌলিক নীতির পরিপন্থি।শ্রমিকদের বহু লড়াই-সংগ্রামে অর্জিত শ্রম আইনগুলিকে চারটি কোডে ভাগ করে লঘু ও অকার্যকর করা হয়েছে। ইচ্ছেমতো কাজে নেওয়া ও ছাঁটাই করার আইনি অধিকার দেওয়া হয়েছে। ওয়েজ কোড বিল আইনে রূপান্তরিত করে জাতীয় ন্যূনতম বেতন দৈনিক মাত্র ১৭৮ টাকা ঘোষণা করা হয়েছে। গণতান্ত্রিক বিরোধিতা ও প্রতিরোধের কণ্ঠরোধ করার জন্য ইউএপিএ আইন সংশোধন করা হয়েছে। এছাড়াও মোদি সরকার আঘাত হেনেছে তথ্যের অধিকার আইনের ওপর। ২০০৫ সালে ইউপিএ আমলে আরটিআই বা তথ্যের অধিকার আইন চালু হয়। এই আইনের বলেই আদর্শ হাউজিং সোসাইটি দুর্নীতি বা টুজি স্পেকট্রাম কেলেঙ্কারির মতো ঘটনাগুলো মানুষের সামনে এসেছে। কিন্তু সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকার তথ্য আধিকারিকদের স্বাধীনতা ও ক্ষমতা খর্ব করার উদ্দেশ্যে তাঁদের নিয়োগ ও চাকরির শর্ত নিজেদের হাতে তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর ফলে একটি স্বয়ংশাসিত সংস্থা কার্যত তার স্বনির্ভরতা এবং আইনি কর্তৃত্ব হারিয়ে ক্ষমতাবান ও কায়েমি স্বার্থভোগীদের বশংবদে পরিণত হচ্চে।
আসলে মোদি-শাহের নেতৃত্বে সমস্ত পুঁজিবাদী শক্তি একত্রিত হয়েছে। দেশি-বিদেশি কর্পোরেট সংস্থাগুলির অবাধ লুণ্ঠনে মদত দেওয়াই তাদের উদ্দেশ্য। এই প্রসঙ্গে বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য অরণ্যের অধিকার আইন(২০০৬) বিষয়ে মোদি সরকারের নীতি।২০০৬ সালের আইনের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছিল আদিবাসী ও অন্যান্য বন-নির্ভর জনগোষ্ঠীভুক্ত মানুষেরা ‘ঐতিহাসিক অন্যায়ের শিকার’। এই আইনের বলে দেশের সর্বত্র গ্রামের ব্যবহার্য জঙ্গল এখন গ্রামসভার সাধারণ সম্পত্তি বা কমিউনিটি ফরেস্ট রিসোর্স। জ্বালানি কাঠ, বাঁশ ইত্যাদি বিভিন্ন অরণ্য সম্পদের ওপর সম্পূর্ণ মালিকানা গ্রামের মানুষের এবং জঙ্গলে মাছ ধরা বা পশুচারণের অধিকারও এই আইনে স্বীকৃত। এর আগে বনভূমিতে বসবাসকারী মানুষের বাস্তু ও কৃষিজমির ওপর আইনি মালিকানা ছিল না। ২০০৬-এর আইন বলছে তাদের রাজস্ব গ্রামে পরিণত করে মালিকানা দিতে হবে। এই আইনের বলেই ২০১৩ সালে নিয়মগিরির আদিবাসীদের গ্রামসভার সিদ্ধান্ত রুখে দিয়েছিল তাদের জল-জঙ্গল-জমির ওপর রাষ্ট্র ও কর্পোরেটের আগ্রাসন। ২০১৪ সালে মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই তাই অরণ্যের অধিকার আইনকে পঙ্গু করার অপচেষ্টা শুরু হয়েছে।
উন্নয়নের নামে আদিবাসী এলাকায় ব্যাপক আকারে খনিশিল্প, বাঁধ, রাস্তা ও রেলপথের প্রসার ঘটছে। এরই সঙ্গে চলছে ব্যাপক হারে নগরায়ণ। এর ফলে আদিবাসীরা জীবনজীবিকা হারানোর সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের স্বাভাবিক বাসস্থান থেকে উৎখাত হতে বাধ্য হচ্ছেন। গত ফেব্রুয়ারি মাসে সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছে যে ভারতের ১৬টি রাজ্যে যারা জঙ্গল এলাকায় বাস করছেন কিন্তু এখনও অরণ্যের অধিকার আইন(২০০৬) অনুসারে আবেদন করেও পাট্টা পাননি, তাদেরকে বাসভূমি ছেড়ে চলে যেতে হবে। এই মামলার অন্যতম পক্ষ ভারত সরকারের পক্ষ থেকে কোনো আইনজীবী বক্তব্য পেশ পর্যন্ত করেননি। এই একতরফা রায়ের ফলে প্রায় ১৯ লক্ষ মূলনিবাসী আজ উচ্ছেদের মুখোমুখি। প্রতিবাদে বিভিন্ন আদিবাসী সংগঠন দেশজুড়ে তীব্র গণ আন্দোলন গড়ে তোলায় আপাতত রায়ের ওপর স্থগিতাদেশ দেওয়া হয়েছে। তবে রায় বাতিল করা হয়নি।(চলবে)