Home ফিরে দেখা বাংলায় তফসিলিদের হিন্দুকরণের ইতিহাস ও যোগেন মন্ডল/৩

বাংলায় তফসিলিদের হিন্দুকরণের ইতিহাস ও যোগেন মন্ডল/৩

বাংলায় তফসিলিদের হিন্দুকরণের ইতিহাস ও যোগেন মন্ডল/৩
0
আশরাফুল আমিন

দ্বিতীয় পর্বের পর

বাংলায় যোগেনের  বহুজনবাদী আদর্শ ধূলিস্যাৎ হওয়ার পরও সরকারি বামেরা ৩৪ বছর থেকেও শ্রেণিবৈষম্যের ভাষ্য দাঁড় করাতে পারেনি।সাম্প্রদায়িক ভাবে বিভাজিত বাংলায় অসাম্প্রদায়িকীকরণে সরকারি বামের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তবে সুদীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থেকেও জাতিবৈষম্যের প্রশ্নগুলিকে তেমন আমল দেয়নি বামনেতৃত্ব। উল্টে ঘুরপথে সাংস্কৃতিক ব্রাহ্মণ্যবাদকে তোল্লাই দিয়েছে। চেয়ার দখল করেছে উচ্চবর্গীয়রা। হাই কালচার আর পপ কালচারে মানুষ বিভাজিত হয়েছে।সংস্কৃতির নিরিখে মানুষ পড়াশোনা জানা ‘ভদ্রলোক’ ও পড়াশোনা না জানা ‘ছোটোলোকে’ ভাগ হয়েছে সরকারি বামের সুদীর্ঘ ৩৪ বছরের রাজনীতিতে। নিম্নবর্গীয়দের সংস্কৃতিকে ‘নিম্নরুচি’ বলে দেগে নাক উঁচু করেছে উচ্চবর্গের বাবুরা। জ্যোতি বসু বলেছিলেন বাংলায় জাতপাত নেই। অথচ শাঁস ছাড়ালেই আঁটির মতো তফসিলিদের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে আসে ‘সোনার চাঁদ’, ‘সোনার টুকরো’, ‘কোটার মাল’ ইত্যাদি ব্যঙ্গ বিদ্রুপের বর্ণবাদী জাতিবিদ্বেষী মানসিকতা।আরও অবাক করা ব্যাপার, সংখ্যার অনুপাতে মাত্র ৬ শতাংশ হয়েও যে উচ্চবর্গীয় শ্রেণি সামাজিক ও  রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ৬০ শতাংশ জায়গা অলিখিতভাবে  সংরক্ষণ করে রেখে দিয়েছে সে বিষয়ে কোন উচ্চবাচ্য নেই। যুগযুগ ধরে রক্ষিত এই সামাজিক সংরক্ষণের বিরুদ্ধে কেউ প্রশ্ন তোলে না।অলিখিত নিষেধ আছে। 

জাতপাতের শিকড় বহু গভীরে প্রোথিত থাকলেও দেশভাগের পর এই  বাংলায় বহুজনবাদী আদর্শের দলিত আন্দোলন দানা বাঁধেনি। যেটুকুই হয়েছে সেগুলোই ‘আমরা’ হয়ে গিয়েছে। ‘আমরা’ বলতে মধ্যবিত্ত উচ্চবর্গীয় বাবুশ্রেণি। এই শ্রেণি সব আন্দোলনের সামনের সারিতে এসে হাইজ্যাক করে নিয়েছে।যাবতীয় গণআন্দোলনের শৌখিন মুখ হয়ে পোষ্টার আলো করেছে উচ্চবর্গীয় শ্রেণি। ফলে আন্দোলন জোরালো হয়নি। তফশিলিরা নিজের লড়াই নিজেরা লড়ার ক্ষেত্র পায়নি ফলতঃ ব্রাহ্মণ্যবাদকে ধাক্কা দেওয়ার মতো কোন শক্তিশালী তফসিলি আন্দোলন গড়ে ওঠেনি বাংলায়। ভারত তথা বাংলার রাজনীতিতে যে শ্রেণিবৈষম্যের সঙ্গে জাতিবৈষম্যের প্রশ্নটি অতঃপ্রতভাবে জড়িত সেটা সরকারি বামেরা বরাবর এড়িয়ে গেছে। প্রথম সারির তফসিলি নেতা উঠেই এল না গত ৩৪ বছরে। উঠে না আসার আসলকারণটি নিহিত রয়েছে যোগেনের বহুজনবাদী আদর্শকে উৎসমূলে পিষে মেরে ফেলার ইতিহাসে। এর দায় বাংলার সমস্ত সুপ্ত ব্রাহ্মণ্যবাদী দলের। অধুনা তৃণমূলের জমানাতেও সেই ট্রাডিশন সমানে চলছে। প্রথম শ্রেণির গরিষ্ঠ নেতাদের শ্রেণি ও জাতিচরিত্র বিচার করলেই অস্বস্তিকর ছবিটি ধরা পড়ে যায়।পর্যাপ্ত তফসিলি প্রতিনিধিত্ব প্রায় কোনো দলেই নেই। বাংলার তফসিলি জনমানসে রাজনৈতিকভাবে (বর্ণ)হিন্দুয়ানি চালিত হওয়ায় দরুণ বর্ণহিন্দু প্রতিনিধিকে তফসিলিরা নিজেদের প্রতিনিধি ভেবে আসছে  দেশভাগের পর থেকে। এই ভাবনার অবধারিত সাইড এফেক্ট হল বর্ণবাদী আধিপত্য বিনা শর্তে মেনে নেওয়া। ঝাড়খণ্ড, বিহার বা উত্তরপ্রদেশ তফসিলি নেতৃত্ব পেয়েছে, কিন্তু পশ্চিমবাংলার মানুষ ভাবতেই পারেন না যে এ রাজ্যে কিস্কু, হেমব্রম, মূর্মু, মাহাত বা বাউরি বাগদি কোটালরা মুখ্যমন্ত্রী হবেন। এরা ‘লড়াকু’ নেতানেত্রী থাকবেন, কিন্তু  মুখ্যমন্ত্রী হবেন না। এসব ভারী ভারী সরকারি বা সাংগঠনিক পদ অলিখিতভাবে বর্ণহিন্দুদের জন্য সংরক্ষিত।এই সংরক্ষণের বিরুদ্ধে প্রশ্ন করতে নেই, ঈশ্বর পাপ দেবেন।(শেষ)

Share Now:

LEAVE YOUR COMMENT

Your email address will not be published. Required fields are marked *