এই ভবিষ্যৎআশঙ্কাটি উপলব্ধি করেই ১৯৪৫ সালে তফসিলি জাতি ফেডারেশনের প্রথম মহাসম্মেলনের সভাপতি হিসাবে প্রকাশ্যে ঘোষণা করে যোগেন মন্ডল বলেছিলেন,”…১৯৪১ সালের লোকগণনায় … তফসিলি জাতির লক্ষ লক্ষ লোককে তফসিলি না লিখিয়া কেবল হিন্দু লেখা হইয়াছে। এই উদ্দেশ্যে কার্যসিদ্ধির জন্য হিন্দু মহাসভা বহু অর্থ খরচ করিয়া লক্ষ লক্ষ লোককে নিযুক্ত করিয়াছে… তফশিলি জাতির পক্ষে এই অন্যায় কার্য প্রতিরোধ করা সম্ভব হয় নাই। ফলে ১৯৪১ সালের লোকসংখ্যায় মুসলমান ও হিন্দুগণ অত্যাধিক বৃদ্ধি পাইলেও তফশিলি জাতির জনসংখ্যা মোটেই বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় নাই। আমরা ১৯৪১ সালের গণনা কিছুতেই মানিয়া লইতে পারি না…”। এমনকি ৪০-এর দশকে হিন্দু মহাসভার তত্ত্বাবধানে তফসিলিদের মধ্যে বাকেরগঞ্জে ৬৫ টি, ঢাকায় ৫০টি, ফরিদপুরের ৪৩ টি, যশোরে ২৯টি এবং খুলনায় ৩১টি শাখা কমিটি গঠিত হয়। তফসিলিরা তখন শ্রেণি ও জাতি পরিচিতি ভুলে ‘হিন্দু’ গর্বে গর্বিত। কিন্তু তাদের এই ‘হিন্দু’ পরিচিতি যে রাজনৈতিক সেটা তারা বুঝে উঠতে পারেনি। হিন্দু মহাসভা যেমন এদের লেঠেল হিসাবে ব্যবহার করেছে, তেমনি অন্যদিকে নিরক্ষর নিম্নবিত্ত মুসলমানদের লেঠেল হিসাবে ব্যবহার করেছে ভূস্বামী জমিদার মুসলমানের দল মুসলিম লিগ। সমাজের নিচু তলার মানুষদের লড়িয়ে দিয়ে নেতৃত্বস্থানীয়রা ফায়দা তুলেছে। নিম্নবর্গীয় হিন্দু ও নিম্নবিত্ত মুসলমানরদের ব্যবহার করে নির্বাচন বৈতরণী পার হওয়ার সেই এলিটীয় ধারা বাংলার রাজনীতিতে আজও বহমান।
বাংলা ভাগের প্রবল বিরোধিতা করেন যোগেন। কারণ তিনি উপলব্ধি করেছিলেন বাংলা ভাগ হলে সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে পূর্ববঙ্গের নমঃশুদ্র সম্প্রদায়। শরৎ বোস, সোহরাবর্দিরাও বাংলাভাগ চাননি। কিন্তু হিন্দু মহাসভার সভাপতি শ্যামাপ্রসাদের প্রচারণা এত জোরালো ছিল যে শেষমেষ বাংলা ভাগ আঁটকানো যায়নি।এদের আপত্তি সত্ত্বেও বাংলা ভাগ হল। বরিশালের যোগেন মন্ডল স্বাধীন পাকিস্তানের প্রথম আইন ও শ্রমমন্ত্রী হলেন। জিন্না যতদিন বেঁচেছিলেন পূর্ব পাকিস্তানে যোগেন মন্ডলের জাতির স্বার্থ রক্ষিত ছিল। কিন্তু জিন্নার মৃত্যুর পর মুসলিম লিগের উপর থেকে তাঁর মোহভঙ্গ ঘটতে থাকে। পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিসর থেকে ব্রাত্য হতে থাকেন যোগেন। তিনি উপলব্ধি করেন মুসলিম লিগ হল উর্দুভাষী আশরফ মুসলমানের দল। নিরক্ষর বাঙালি মুসলমানদের এরা ব্যবহার করে। নমঃশূদ্রকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে ‘অপর’ করে দেয়। তার উপর দেখা দেয় নমঃশুদ্রদের উপর সংখ্যাগুরু মুসলিমদের অত্যাচার। সময়টা ছিল দুই বাংলার গরমাগরম দাঙ্গার রাজনীতি।
পাকিস্তানে ১৯৫৪-এর নির্বাচনে যোগেন মন্ডলের দাবি মতো সংখ্যালঘুদের জন্য সংরক্ষণ সহ পৃথক নির্বাচনী ব্যবস্থা পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু ১৯৫৫ তে আওয়ামি লিগের হস্তক্ষেপে পৃথক নির্বাচনী ব্যবস্থা বাতিল হয়ে যুক্ত নির্বাচন ব্যবস্থা চালু হয়। যোগেনের সব আশা নিভে যায়। প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলিকে পদত্যাগপত্র দিয়ে হতাশ হয়ে পশ্চিম বাংলায় চলে আসেন যোগেন।এখানে এসে উদ্বাস্তুদের নিয়ে নতুন রাজনৈতিক ভাষ্য নির্মাণ করার চেষ্টা শুরু করেন। সফল হননি। ভোটে বেশ কয়েকবার লড়েও জায়গা করতে পারলেন না যোগেন। সারাজীবন দিয়ে তিনি উপলব্ধি করেন জাতীয় কংগ্রেস, হিন্দু মহাসভা, মুসলিম লিগ বা আওয়ামি লিগ হল দেশজ এলিটের রাজনৈতিক মঞ্চ। এরা কোনোদিনই তফশিলিদের জন্য রাজনৈতিক ক্ষেত্র ছেড়ে দেবে না। যেকোনো রাজনৈতিক দলেই তফশিলি শ্রেণি সাধারণ ভোটার বা বড়জোর স্থানীয় ক্যাডার। প্রথম সারির মুখ নয়। যোগেনের এহেন প্রতিনিধিত্বমূলক বহুজনবাদী রাজনীতির অপমৃত্যুর ফলস্বরূপ দুই বাংলার ইতিহাসচর্চা ও রাজনৈতিক পরিসরটি কেবল হিন্দু-মুসলিম ভাষ্যে আঁটকে থেকে গেল।জাতিবৈষম্য ও ব্রাহ্মণ্যবাদবিরোধী বহুজনের আদর্শ রাজনৈতিক আলোচনার ক্ষেত্র থেকে হারিয়ে গেল। যোগেনের উপলব্ধি যে ভুল ছিল না আজকের দুই বাংলার রাজনৈতিক দলের শীর্ষস্থানীয় নেতানেতৃদের জাতি ও শ্রেণিচরিত্র চোখ খুলে দেখলেই বুঝে নেওয়া যায়। (চলবে)