Home ফিরে দেখা বাংলায় তফসিলিদের হিন্দুকরণের ইতিহাস ও যোগেন মন্ডল/১

বাংলায় তফসিলিদের হিন্দুকরণের ইতিহাস ও যোগেন মন্ডল/১

বাংলায় তফসিলিদের হিন্দুকরণের ইতিহাস ও যোগেন মন্ডল/১
0
আশরাফুল আমিন

ঔপনিবেশিক ভারতের বাংলায় বহুজনবাদী আদর্শের অঙ্কুরোদ্গম হয় যোগেন মন্ডলের হাত ধরে। দেশভাগের আগের দশকগুলোতে এই আদর্শ বিকশিত হওয়ার পরিসর তৈরি হলেও শেষমেষ নুইয়ে পড়ে জাতীয় কংগ্রেস এবং হিন্দু মহাসভার সুপরিকল্পিত বিরোধিতায়। জাতীয় কংগ্রেস ছিল ধর্মনিরপেক্ষতার নামে বর্ণহিন্দুদের দল আর হিন্দু মহাসভা খোলাখুলিভাবে গোঁড়া বর্ণহিন্দুদের রাজনৈতিক মঞ্চ। যোগেন ছিলেন নমঃশূদ্র কৃষক সন্তান। নিজ জাতির প্রতিনিধিত্ব তৎকালীন বাংলার রাজনৈতিক পরিসরে খুঁজে পাননি। তাই ‘নিপীড়িত শ্রেণির হিস্যা’কে সম্বল করেই তার রাজনৈতিক জীবন শুরু। দাবি ছিল নিপীড়িত দলিত শ্রেণির জন্য পৃথক নির্বাচনী ব্যবস্থা। কারণ গুরু আম্বেদকরের মতো তিনিও পরিসংখ্যান মারফত উপলব্ধি করেছিলেন অভিন্ন নির্বাচনী ব্যবস্থায়  তফশিলিদের প্রতিনিধিত্ব সম্ভব নয়। বর্ণহিন্দুরা বরাবরের মতো অভিন্নতা ও নিজেদের সকল ভারতীয়ের প্রতিনিধি দাবি করে রাজনৈতিক পরিসরটি প্রায় একচ্ছত্রভাবে নিজেদের কবজায় রেখে দেবে বলে তিনি মনে  করেছিলেন। তাঁর মতে অভিন্ন  নির্বাচনী ব্যবস্থা মানে ঘুরপথে বর্ণহিন্দু আধিপত্য মেনে নেওয়া। 

দেশভাগের আগের বছরগুলোতে যোগেনের মনে হয়েছিল মুসলিম লিগের সঙ্গে হাত মেলালে হয়ত তফসিলিদের প্রতিনিধিত্ব রক্ষিত হবে। তিনি মুসলিম লিগকে রাজনৈতিক মিত্র হিসাবে দেখতে শুরু করেন। যদিও পরবর্তীতে তিনি  উপলব্ধি করেন মুসলিম লিগ মোটেই খেটে খাওয়া  কৃষিজীবী  মুসলমান নয়, ভূস্বামী জমিদার  মুসলমানের দল। তিনি মনে করতেন আর্থসামাজিক দিক দিয়ে ও নৃতাত্ত্বিকভাবে বাংলার কৃষিজীবী খেটে খাওয়া মুসলমান আর কৃষিজীবী নমঃশূদ্র একই স্তরে অবস্থান করে। প্রায়শই তাঁকে বলতে শোনা যেত, “জমির আল যার সাথে আন্দোলন তার সাথে”। রাজনৈতিক প্রয়োজন বুঝেই মুসলিম লিগের সঙ্গে হাত মেলান যোগেন। মুসলিম লিগও যোগেন মন্ডলের বেশ কিছু দাবিকে মান্যতা দেয়। তার মধ্যে অন্যতম ছিল তফশিলিদের উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব, যা ছিল ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে অভূতপূর্ব। মুসলিম লিগের সঙ্গে সখ্য কংগ্রেস ও বিজেপির পূর্বসুরি হিন্দু মহাসভার সুপ্ত বর্ণবাদী রাজনীতির কাছে ছিল বিপদ। দলিত ভোটের সিংহভাগ হাতছাড়া হয়ে গেলে ক্ষমতার কুর্সি ধরে রাখা মুশকিল ছিল এদের পক্ষে। ঠিক এই লক্ষ্যেই ১৯২০-৩০ এর দশকে তফশিলিদের হিন্দুকরণের রাজনীতি শুরু হয়।

পঞ্চানন বর্মার নেতৃত্বে ক্ষাত্র আন্দোলন স্বতন্ত্র রাজবংশী জাতিমানসে ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্কৃতি সঞ্চালিত করে ‘হিন্দু’ বানানোর প্রক্রিয়া চলে ১৯২০-র দশকে। এরপর ১৯৩০-এর  দশকে এক এক করে আসে সত্যাগ্রহের নামে ‘অচ্ছুৎ’ তফশিলিদের জন্য হঠাৎ করে মন্দিরের দরজা খুলে দেওয়া, ক্ষত্রিয় পরিচয় প্রদান এবং হিন্দু মহাসভার উদ্যোগে হিন্দুমেলার আয়োজন। তফশিলিদের ‘শুদ্ধিকরণের’ মাধ্যমে হিন্দু পরিচিতির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়াই ছিল হিন্দুমেলার উদ্দেশ্য। এর ফলে দুটি লাভ হয়েছিল। প্রথমত, তফসিলিদের প্রতিনিধিত্ব ও বঞ্চনার যে প্রশ্নগুলি জোরালোভাবে উত্থাপিত হতে শুরু করেছিল সেগুলো কিছুটা চেপে দেওয়া গেল এবং দ্বিতীয়ত, হিন্দু মহাসভা যে হিন্দুত্বের রাজনীতি করে সেই স্রোতে তফসিলিদের দলে টেনে দলে ভাসিয়ে দেওয়া গেল।

এহেন হিন্দু রাজনৈতিক পরিচিতির গেরোয় যোগেনের বহুজনবাদী রাজনীতি বেশ কিছুটা ধাক্কা খায়। তবুও ১৯৩৭-এর প্রাদেশিক নির্বাচনে অভিজাত পরিবারের সরল দত্তকে হারিয়েছিলেন দুই হাজার ভোটে। তাৎপর্যপূর্ণভাবে এই নির্বাচনে কৃষক প্রজা পার্টির বাঙালি মুসলমান কৃষকের ছেলে ফজলুল হকের কাছে বড়ো ব্যবধানে হারেন মুসলিম লিগের নবাব বংশীয় প্রার্থী নাজিমুদ্দিন। দুই কৃষক পরিবারের সন্তানের এই জয় যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। অন্যদিকে এইসময় তফসিলি মতুয়া আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন গুরুচাঁদ ঠাকুরের প্রপুত্র প্রমথরঞ্জন ঠাকুর। প্রমথরঞ্জন কোন রাজনৈতিক মিত্রের খোঁজ করেননি।রাজনৈতিক ব্রাহ্মণ্যবাদের স্বরূপও উপলব্ধি করতে পারেননি। এর ফলে জাতীয় কংগ্রেস ভোট বাক্সে প্রায় পুরো মতুয়া সম্প্রদায়কে হাইজ্যাক করে নিতে সফল হয়। এখন আবার মতুয়া সম্প্রদায় মনুবাদী বিজেপির ভোটব্যাঙ্ক।জাতির প্রতি সামাজিক বঞ্চনার  প্রশ্নটি ভুলে গিয়ে কৌমভিত্তিকভাবে ব্রাহ্মণ্যবাদী দলের সঙ্গে হাত মেলানোর ভুল মতুয়া সম্প্রদায় আগেও করেছে, এখনও করছে। 

যাই হোক, বহুজনবাদী আদর্শ বিকাশের নিখুঁত সময় এলেও একজোট হওয়ার বদলে নমঃশুদ্র, রাজবংশী, মতুয়া  তপশিলি এবং নিম্নবিত্ত কৃষিজীবী মুসলমানেরা কৌমভিত্তিকভাবে বিভক্ত ছিল। এই বিভক্তি কংগ্রেস, হিন্দু  মহাসভা ও ভূস্বামী আশরফ মুসলমানের দল মুসলিম লিগের সুবিধা করে দেয়।কিন্তু এরা বহুজনের আদর্শে একটি ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক মঞ্চ গড়ে তুলতে পারলে দেশের ইতিহাস পাল্টে যেত। বাংলার রাজনীতির ধারা আজ অন্য খাতে বইত। বহুজনের  রাজনৈতিক আদর্শকে বিকশিত হতে দেওয়া হয়নি বলেই এত বছর পরে আজও সংখ্যাগরিষ্ঠ অনগ্রসর ৮৫% এর উপর মাত্র ৬% দেশীয় উচ্চবর্গীয় এলিটের ছড়ি ঘোরানোর রাজনীতি বহমান। দেশভাগের এতবছর পরেও রাজনৈতিক ব্রাহ্মণ্যবাদের অবদমন থেকে তফসিলিদেরও মুক্তি ঘটেনি। সাংবিধানিকভাবে সুষম সামাজিক প্রতিনিধিত্বের বিষয়টি ‘সংরক্ষণ’ অপবাদ নিয়ে আজও পথ চলতে হয় তফসিলিদের। (চলবে)

আরও পড়ুন: বাংলায় তফসিলিদের হিন্দুকরণের ইতিহাস ও যোগেন মন্ডল/২

ছবি: পাকিস্তানের প্রথম আইনমন্ত্রী পদে শপথ নিচ্ছেন যোগেন মন্ডল

সৌজন্য: আইবিটাইমস

Share Now:

LEAVE YOUR COMMENT

Your email address will not be published. Required fields are marked *