(লেখক দেড় দশক ধরে রাজ্যের প্রায় সবকটি সংবাদ চ্যানেলে কাজ করেছেন ও করছেন। তাই স্বনামে লিখতে পারলেন না। ছদ্মনাম দেওয়ার কোনো অর্থ নেই বলে আমরা মনে করছি- সম্পাদকমণ্ডলী)
কথায় কথায় শোনা যায়, সংবাদমাধ্যম নাকি গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ। বাকি তিনটি তাহলে কী? সেগুলির কথা বড়ো একটা শোনা যায় না। আসলে, সেই প্রাতিষ্ঠানিক ধারণাগুলি তেমন পপুলার নয়। আমাদের দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাটির মূল চালিকা শক্তি তিনটি। প্রথমত বিচার ব্যবস্থা, দ্বিতীয়ত নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ও তৃতীয়ত কার্যনির্বাহী বিভাগ। সাংবিধানিক ভাবে এগুলি স্বীকৃত। কিন্তু, চতুর্থ স্তম্ভের দায় ও দায়িত্বের তেমন সাংবিধানিক স্বীকৃতি নেই৷ তা অনেকটা নির্ভর করে প্রেস এথিক্সের উপর। কিন্তু, সেও যে ক্ষণভঙ্গুর তা তো নিত্যদিনের অভিজ্ঞতাতেই বোধগম্য।
দেখুন: বিশ্বভারতীতে সিআইএসএফ নিয়োগ কি অনুমোদন করতেন রবীন্দ্রনাথ? ভিডিও
ট্রেনে, বাসে, চায়ের দোকানে, আড্ডায় রোজই আলোচনায় উঠে আসে সংবাদমাধ্যমে দেখানো নানা ঘটনার কথা। বেশিরভাগ ধারণাই টিভিতে বা খবরের কাগজে বা ওয়েবসাইটে যা দেখানো হচ্ছে তার উপর নির্ভর করে তৈরি। কিন্তু, seeing মানেই believing নয়। সংবাদমাধ্যমে কাজ করার সূত্রে ব্যক্তিগত স্তরে আলোচনায় অনেক ক্ষেত্রেই নানা প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়। সময়টা ২০১০ সাল নাগাদ। টি আর পির দিক থেকে (তখনও BARC ব্যবস্থা আসেনি) রাজ্যের একনম্বর টিভি চ্যানেলের কর্মী। অফিসে যাওয়ার সময়, প্রায় ফাঁকা ট্রেনে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হল। সরকারি কর্মচারী। তিনি অফিস থেকে বাড়ি ফিরছেন। আর আমি যাচ্ছি। ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন, সংবাদমাধ্যম (মূলত টিভি চ্যানেল) সত্যের এমন অপলাপ করে কেন? ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনের ফলে রাজ্যের বাম সরকারের বিদায় বাদ্যির অনুরণন তখনই শোনা যাচ্ছে। আমি ভদ্রলোককে বললাম, যা সত্যি মনে হচ্ছে, তা আসলে সত্যি নয়। একটি ঘটনা দু’ভাবেই দেখা যেতে পারে। নেতিবাচক অথবা ইতিবাচক। দুটি দিকই আছে।সংবাদমাধ্যম ঠিক এই কৌশলই করে থাকে। এমনই মায়া তৈরি করে। তাই, অনেক সময় কোনো ঘটনার সমর্থনে ব্যাপক জনমত থাকলেও সংবাদমাধ্যম কখনও কখনও ঠিক তার উলটো পথে হাঁটে। এগুলির কোনও স্বতঃসিদ্ধ সূত্রও নেই। পুরো বিষয়টি নির্ভর করে রাজনৈতিক সমীকরণের উপরে। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের জমি অধিগ্রহণ ঘিরে রাজ্যের তৎকালীন বাম সরকার ব্যাপক বিরোধিতার মুখে পড়ে। কৃষক ‘দরদি’ বাম সরকারের পতনের সেটাই যে মূল কারণ তা আর নতুন করে বলতে হয় না। কিন্তু, পরিবর্তনের সরকারের আমলে ভাঙড়ে পাওয়ার গ্রিড বিরোধী আন্দোলন বা বোলপুরের শিবপুরে জমি অধিগ্রহণ বিরোধী আন্দোলন তৈরি হয়েছে। অথচ, তার ‘সাফল্য’ তেমন ভাবে দেখতে পায়নি বহু ‘মূলধারা’র সংবাদমাধ্যম। কারণ, এডিটোরিয়াল পলিসির ‘মায়াবাদ’। ইহাও হয় আবার উহাও হয়, এই দ্বান্দ্বিকতার গেরোয় আটকে গিয়েছে সাধারণ মানুষের কথা। তখন যেখানে কাজ করতাম সেখানে চ্যানেলের মাথারা সরকারপক্ষের সমর্থনে নিত্যদিন হন্যে হয়ে যুক্তি খুঁজতেন। সেই যুক্তিই নানা ছবি, নানা চরিত্রের বক্তব্যের অংশ ও ভয়েস ওভার দিয়ে প্রমাণ করতে হতো। মানুষ এটাই ‘খবর’ হিসেবে দেখতেন। ঠিক যেন মাধ্যমিকের অঙ্ক পরীক্ষায় জ্যামিতির এক্সট্রা প্রমাণ করা। ভাঙড় বা শিবপুরের জমি অধিগ্রহণ বিরোধী আন্দোলনকে স্রেফ ‘স্থানীয় ভাবনা’ বলে রাজ্যের মানুষকে দেখানো এবং বোঝানো। একই কথা বলা যায়, গোর্খাল্যান্ডের দাবিতে পাহাড়বাসীর আন্দোলন নিয়েও। একই কথা খাটে নোনাডাঙার বস্তি উচ্ছেদ নিয়েও।
কোনো এক পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে, একটি রাজনৈতিক দলের মুখপত্রে কাজ করতাম। কলকাতার অফিসে জেলার খবর পাঠাতাম। একদিন কলকাতার ডেস্ক থেকে ফোন এল। ‘বাদুড়িয়ার এক কৃষকের নাম বলুন তো?’ আমার মাথায় তেমন কারও নাম আসছিল না। একটা নাম বানিয়ে বানিয়েই বললাম। পরদিন কাগজে দেখি, রাজ্যে কত মানুষের কাছে রাজ্য সরকার বিদ্যুৎ পৌঁছে দিয়েছে, সেই সাফল্য নিয়ে লেখা একটি খবর। খবরের সঙ্গে অনুপাত মতো পরিসংখ্যানও আছে। সেখানে লেখা, ‘বাদুড়িয়ার কৃষক বিনয় দাস (ওই নামটিই বলেছিলাম) জানালেন, রাজ্য সরকার সকলের কাছে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিয়েছে। আমরা তা চাষের কাজে লাগাচ্ছি। সেচে আগের থেকে অনেক সুবিধা হচ্ছে।’ এখানে এই ‘আগের থেকে’ কথাটিই বেশি গুরুত্বপূর্ণ! সেসময়, ফোটোগ্রাফারের ছবিতে মাঝে মাঝেই ‘লাল ঝান্ডা’ আর ‘মানুষ’ কম পড়িত। আর তা আমদানি করত ফোটোশপ! আপনি পাঠক, দর্শক বা শ্রোতা হিসেবে এই ভাবের ঘরে চুরি কোনওদিনই ধরতে পারবেন না। ১০০ শতাংশ গ্যারান্টি!
নানা চ্যানেলে কাজ করার সময় দেখেছি, সকালে লেখা ব্রেকিং নিউজ কীভাবে দুপুরে বদলে যেত। সেখানেও ওই, এডিটোরিয়াল পলিসির মায়াবাদের ছোঁয়া! পরিসংখ্যান ভিত্তিক খবরের ক্ষেত্রেও একই সূত্র প্রযোজ্য। সরকারপক্ষের চ্যানেলে বাছাই করা শুধুমাত্র পজিটিভ তথ্যগুলিই তুলে ধরা হয়। কোনও ক্ষেত্রে সরকারের পারফরমেন্স খারাপ হলে সেই খবর এড়িয়েই যাওয়া হয়। ইদানিং, রাজ্যে অপরাধ, নারী নির্যাতনের ঘটনা বাড়লেও তা নিয়ে সাধারণত, টিভি চ্যানেলগুলিতে খবর হয়নি। অথচ, এটাই এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে জনপ্রিয় মাধ্যম। আসলে, রাজনৈতিক ক্ষমতা একটি চুম্বক। সেই চৌম্বকীয় ক্ষেত্রে থেকে ক্ষমতার আকর্ষণ উপেক্ষা করতে পারে না বহু সংবাদমাধ্যমই। আর করলেও, তার পিছনে নানা সমীকরণ থাকে। এখানে পুঁজির গতি ঠিক করে দেয় বেশিরভাগ সাধারণ মানুষ ও সংবাদমাধ্যমের রাজনৈতিক অভিমুখ। সংবাদমাধ্যমে প্রচলিত লবজ, ‘খবরটা খাচ্ছে কিনা দেখ।’
মানুষের ‘খাদ্যাভ্যাস’ খুঁজে বেড়ায় টিভি চ্যানেল। বারবার নিজের অভ্যাস বদলায়। মানুষ সম্পর্কে ধারণা তৈরি করে। যখন লাগে তুক। না লাগলে ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে রাজ্যে তৃণমূল সরকারের ‘ভুল’ না দেখা চ্যানেলগুলির অবস্থা হয়। এসি ঘর থেকে মাটির কাছাকাছি গিয়ে ব্যাপক ক্ষোভের আঁচ পেয়েছিলেন রাজ্যের ভোট বিশেষজ্ঞরা। কী উত্তরবঙ্গ, কী জঙ্গলমহল বা কী রাজ্যের বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী জেলা। এসব জায়গায় বিজেপির দাপট ভয়াবহ। কিন্তু, নানা কারণে সেকথা বলতে পারেননি চ্যানেলগুলির কর্তারা। রাতারাতি বদলাতে হয়েছিল সেই ‘মার্কশিট’। প্রথম ধাক্কাটা লাগে, এক্সিট পোলের দিন। দেশে ও রাজ্যে বিজেপির উত্থান দেখে চ্যানেলের কর্তাদের তখন মাথায় হাত! রেখেঢেকে অনেক কিছু বলা হল বটে। কিন্তু, তৃণমূলের ‘ক্ষতি’ মেরামত করা যায়নি। বরং যা হওয়ার তাই হয়েছে।
কয়েকটি চ্যানেলে কাজ করার সময় অদ্ভুত পরিস্থিতি দেখেছি। কোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা নিয়ে ডেস্কে তেমন আলোচনাই হয় না। খবরে অনেক ‘মনগড়া’ কথা লেখা হয়। আদৌ সেদিকেই হয়তো ঘটনার অভিমুখ নয়। আসলে, টিভি চ্যানেলের অফিসে কোনও খবর আসা আর তা দেখানো র মধ্যে অনেক ফাঁকফোকর আছে। তার কপির ভাষাও ভাসা ভাসা। আগেই বলেছি, ইহাও হয়, উহাও হয়। এরই সুবিধা নেয় টিভি চ্যানেলগুলি।
শুরুতে ছোটোখাটো একটি চ্যানেলে কাজ করতাম। একবার চ্যানেলটি দারুণ আর্থিক সমস্যায় পড়েছিল। আমাদের বেতন আটকে গিয়েছে। রাজ্যের সে সময়ের এক বাম সাংসদ সাহায্য করেছিলেন তখন। (একসময়ের প্রবল পরাক্রান্ত উত্তরের সেই বামনেতা অবশ্য এবার ভোটযুদ্ধে হার মেনেছেন।) তা যাই হোক, আমাদের সেই চ্যানেলটি যে আর বামেদের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস দেখাবে না তা নিয়ে রীতিমতো আস্ফালন করেছিলেন ওই বামনেতা।
২০১১ সালে রাজ্যের মহানাগরিক চ্যানেলটিতে রাতে নিয়ম করে একটি শোভন ভাষায় কথা বলা ফোন আসত। ফোনের ওপারের সেই তিনিই অনেক রাজনৈতিক খবরের ‘লাইন’ ঠিক করে দিতেন৷ সেই চ্যানেলই অবশ্য ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচনের এক্সিট পোলে বামেদের ফিরিয়ে এনেছিল। তৃণমূল ক্ষমতায় দ্বিতীয়বার আসতেই প্রথমে বদলা ও পরে বদল আসে চ্যানেলটিতে।
টিভি চ্যানেলগুলির আয় মূলত নির্ভর করে বিজ্ঞাপনের উপর। তেল, সাবান, ফেয়ারনেস ক্রিম, এমন নানা এফএমসিজি গুডসের বিজ্ঞাপনে প্রায় সব টিভি চ্যানেলই ভরপুর। আরওঅন্যান্য বিজ্ঞাপন তো আছেই। চ্যানেলের দর্শকদের কথা মাথায় রেখে খবরের ক্ষেত্রেও নানা অনুষঙ্গ খোঁজা হয়। দর্শকদের (যাঁরা ওই টিভি চ্যানেলের খবর ও বিজ্ঞাপন দেখছেন) নির্দিষ্ট গণ্ডির ভিতর আটকে দেওয়া হয়। দর্শকরা ‘ভদ্রলোক’ এটা ধরে নিয়েই চ্যানেলে কখনই খালি গায়ে মানুষের ছবি বা বাইট দেখানো হয় না। কোন খবর দেখানো হবে তারও নানা ‘কারণ’ খুঁজে বের করা হয়। যেমন, অনেক খবরের ক্ষেত্রেই অভিযোগকারী বা অভিযোগকারিণীর আর্থ-সামাজিক অবস্থানকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। এমনকী তিনি মহিলা হলে তাঁকে দেখতে কেমন? টিভি স্ক্রিনে তাঁকে কেমন দেখাবে তাও গুরুত্ব দিয়ে ভাবা হয়। এতদিন ধরে তো টিভি দেখছেন, একজনও স্বাভাবিক রঙের মহিলা অ্যাঙ্কর খুঁজে পেয়েছেন?
খবরের কুশীলব যাঁরা তাঁরা কতটা আপ মার্কেট, বাংলার সঙ্গে তাঁরা কতটা ইংরিজি মিশিয়ে কথা বলছেন, চামড়া কতটা সাদার দিকে, এসব চুলচেরা বিশ্লেষণের পর খবর শেষপর্যন্ত দেখানো হয়। সব লক্ষণ মিলে গেলে সোনায় সোহাগা। নাহলে আপনি রবেন হতাশের, নিষ্ফলের দলে।
কথায় কথায় আমরা ‘সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা’ কথাটি বলতে অভ্যস্ত। সত্যিই কি সংবাদমাধ্যমের ‘স্বাধীনতা’ আছে? সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা আসলে তার মালিকেরই স্বাধীনতা। পুঁজির সেই ‘লাভজনক’ পথেই অহরহ তৈরি হচ্ছে খবরের অ্যাঙ্গেল বা দৃষ্টিকোণ। আগে হয়তো তা নির্দিষ্ট খবরের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ ছিল। এখন মনে হয় চাপ খুবই বেড়ে গেছে! তাই কোনও খবরই সেই অ্যাঙ্গেলের আওতা থেকে বাদ যাচ্ছে না। সে বহুতলে আগুন হোক বা বহুতলে খুন। সংবাদমাধ্যমের মালিক যেন গাইড। আর দর্শককে নিজের ইচ্ছামতো তিনিই পথ দেখাচ্ছেন।
কলকাতার একটি ‘ঐতিহ্যশালী’ নার্সিংহোমে আগুন লেগে রোগীদের মৃত্যুমিছিল। এই মর্মান্তিক খবর কখনই ভোলার নয়। তখন, যে চ্যানেলে কাজ করতাম সেখানে নার্সিংহোম কর্তৃপক্ষের মূল সংস্থার বিজ্ঞাপন রোজ যেত। ভোজ্য তেল, ফেয়ারনেস ক্রিম, এসব আর কী। এত বড়ো খবর। কিন্তু, তা সত্ত্বেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেও খবরে সংস্থাটির নাম দেওয়া হত না। কারণ, ‘ওরা বিজ্ঞাপন দেয়’। এমনটা ঘটেছিল রাফাল মামলা সংক্রান্ত খবর নিয়েও। ওই মামলায় অভিযোগ দেশের কোন ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে তা সকলেই জানেন। কিন্তু, কলকাতার একটি নির্দিষ্ট চ্যানেলে রাফাল সংক্রান্ত কোনও খবরে কোনওদিন সেই ব্যবসায়ীর নাম লেখা হয়নি। এই সৌভ্রাতৃত্বের কারণ কী? সহজেই অনুমেয়।
এমন কতো খবরের ভিতরে লুকিয়ে থাকে আরও নানা খবর। সেই অজ্ঞাত রহস্য, অলখ নিরঞ্জনের সন্ধান মেলা বড়ো কঠিন।
ছবি সৌজন্য: মানিলাইফ