১৯৯২-এ অযোধ্যায় করসেবকদের সংগঠিত আক্রমণে বাবরি মসজিদের ইমারত ভেঙে পড়তে যে সময়টুকু নিয়েছিল, ২০১৯-এ তার থেকে অনেক কম সময়ে ভেঙে পড়ল ভারতীয় রাষ্ট্রের বিচারব্যবস্থার উপর সংখ্যালঘু মানুষের বিশ্বাসের শেষ বনিয়াদ।৯ নভেম্বর তারিখটি পৃথিবীর ধর্মনিরপেক্ষতার ইতিহাসের বইয়ে কলঙ্কিত অধ্যায়ের একটি পৃষ্ঠাসংখ্যা হয়ে উঠতে গিয়ে দেখলো – কী আশ্চর্য! সেই পৃষ্ঠাটি ইতিমধ্যেই দখল করে বসে আছে আরেকটি ৯ নভেম্বর! ১৯৩৮ সালের।
আরও পড়ুন: ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ বলা সঙ’-এ পরিণত হচ্ছে গণতন্ত্রের স্তম্ভগুলি
ক্রিস্তালনখট। ভাঙা কাঁচের রাত্তির। ১৯৩৮-এর ৯ ও ১০ নভেম্বর এই দু’দিন ধরে জার্মানি, অস্ট্রিয়া আর জার্মানি অধিকৃত তখনকার চেকোস্লোভাকিয়ার বিভিন্ন শহরে ইহুদি জনগোষ্ঠীর মানুষদের ঘরবাড়ি,দোকানপাট, সিনাগগগুলি আর প্রাণের উপর সংগঠিতভাবে এক গণতাণ্ডব চালানো হয়। ইহুদিদের উপর এই গণআক্রমন মোটেই স্বতঃস্ফূর্ত ছিল না, বরং তা সংগঠিত ভাবে ঘটানো হয়েছিল। ইহুদিদের উপর এই জনরোষের অজুহাত হিসাবে যেটিকে দেখানো হয়, সেটিও যথেষ্ট মর্মস্পর্শী।এটি হলো জর্মন ডিপ্লোম্যাট আর্নস্ট ভম রাথের হত্যা, যা হয়েছিল হার্শেল গ্রিনজপ্যান নামের এক পোলিশ কিশোরের হাতে, প্যারিসে। হার্শেল সেই ১২০০০ “পরদেশি” ইহুদির একজন, যাদের ১৯৩৮-এর অক্টোবর মাসে হিটলার নাগরিকত্ব বাতিল করে জার্মানি থেকে বের করে দিয়েছিল।হার্শেল প্যারিসে কাকার বাড়িতে আশ্রয় পায়, তার বাকি পরিবার পড়ে থাকে পোলিশ সীমান্তে। জানা যায়, বাবা মা-র কাছ থেকে আশা ফুরিয়ে যাওয়া জীবনের একটি যন্ত্রণাকাতর চিঠি পেয়ে হার্শেল ওই দুঃসাহসী সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে। একটি রিভলবার জোগাড় করে সে, এবং ৭ নভেম্বর সকালে প্যারিসের জার্মান এমব্যাসিতে পৌঁছে ডিপ্লোম্যাট আর্নস্টকে গুলি করে।
আর্নস্ট হাসপাতালে মারা যান এর দু’দিনের মাথায়। সেইদিন হিটলার নাৎসি পার্টির কর্তাব্যক্তিদের সাথে একটা নৈশভোজ বৈঠকে ব্যস্ত ছিলেন। এই খবর পেয়ে আলাপচারিতাকে ‘নিচুস্বরে কিছু জরুরি আলোচনায়’ বদলে দিয়ে দ্রুত চলে যান। এরপর গ্যোয়েবলস হিটলারের নির্দেশকে ঘোষণা করে বলেন – ফ্যুরারের ইচ্ছে নয় এর বিরুদ্ধে কোনো মিটিং মিছিল করা হোক। সকলকে সংযত থাকতে হবে। কিন্তু যদি জনতার মধ্যে থেকে স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ ওঠে, তাকেও ব্যাহত করা উচিত হবে না। এর পরেই এস এস কর্তা ম্যুলের-এর নির্দেশ পৌঁছোয় কম্যান্ডারদের কাছে – ইহুদিদের বিরুদ্ধে চরম পদক্ষেপের সংকেত দিয়ে। রাত ১টার পর থেকে আক্রমণ নামে। ইহুদিদের ঘরবাড়ি,স্কুল এমনকি হাসপাতালগুলির উপরেও। গুজরাটে বা বার্লিনে, যে কোনো দাঙ্গার পিছনেই একটা অর্থনৈতিক এজেন্ডামও কাজ করে। সুতরাং শহরে শহরে ইহুদিদের পরিচালনায় থাকা দোকানপাট সহজ আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয়। মাত্র দুদিনের এই দাঙ্গায় সাতহাজারেরও বেশি ছোট বড় বিপণি ও ব্যবসাকেন্দ্র ভেঙেচুরে দেওয়া হয়। দোকানের কাঁচ ভাঙা থেকেই ‘ক্রিস্তালনখট’ শব্দটির জন্ম। তিরিশ হাজারের উপর ইহুদিকে গ্রেফতার করা হয়। প্রাণ হারান যাঁরা তাদের সংখ্যা নব্বই না আরো অনেক বেশি, তা নিয়ে এখনও বিতর্ক আছে। ডেইলি টেলিগ্রাফ-এর বার্লিন করেসপন্ডেন্ট হিউ গ্রিন প্রতিবেদনে লিখেছিলেন, “বিকেল আর সন্ধ্যা জুড়ে উশৃঙ্খল জনতার আইনই বার্লিন শহরকে শাসন করছিল, গুন্ডা আর লুম্পেনরা মেতে উঠেছিল ধ্বংসের লাম্পট্যে।গত পাঁচ বছরে আমি জার্মানিতে ইহুদিবিদ্বেষ নেহাত কম দেখিনি, কিন্তু এর মতো অসুস্থ কিছু জীবনে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। এমনিতে ভদ্র মানুষজনদের মাথায়ও সেদিন বোধ হয় জাতিবিদ্বেষ আর হিস্টিরিয়ার ভূত সওয়ার হয়েছিল। নিজের চোখে ফ্যাশনদুরস্ত মহিলাদের দেখেছি হাততালি দিয়ে আনন্দে চেঁচিয়ে উঠতে, ভদ্র সভ্য মধ্যবিত্ত মায়েদের দেখেছি দুহাতে তাদের বাচ্চাদের তুলে ধরতে, যাতে তারা ‘মজা’টুকু দেখতে পারে।” গোধরা পরবর্তী গুজরাট মনে পড়ছে বুঝি?
ক্রিস্তালনখট ছিল ইহুদিবিদ্বেষী ‘হলোকাস্ট’-এর সূচনাপর্ব, জার্মানি অধিকৃত ইউরোপ ও তার সহযোগী দেশগুলিতে জুড়ে যে গণহত্যার শিকার হয়েছিলেন ৬০ লক্ষের বেশি ইউরোপীয় ইহুদি মানুষ।
দোকান, স্কুল, হাসপাতাল, বাড়িঘর সব ভাঙা পোড়ানো চললেও শহরে শহরে যা আক্রমণের প্রথম ও প্রধান লক্ষ্যবস্তু হয়েছিল সে’রাতে এবং পরের দিনভর, তা ছিল ইহুদি উপাসনাগৃহ – সিনাগগগুলি। বাবরি মসজিদ ভাঙার মতোই, যতই ধোঁকার টাটি খাড়া করা হোক, এগুলিও স্বতঃস্ফূর্ত ছিল না। বস্তুত, ক্রিস্তালনখটের আগের মাসগুলিতেই স্থানীয় নাৎসি নেতাদের নির্দেশ ও সক্রিয় সমর্থনে ম্যুনিখ, ন্যূরেমবুর্গ, ডর্টমুন্ড, কাইসারসল্যুটেরনে সিনাগগ ধ্বংস করা শুরু হয়ে গিয়েছিল। নভেম্বরের ৯ ও ১০-এ তা দেশ জুড়ে এক সর্বগ্রাসী চেহারা নেয়। প্রত্যেকটি সিনাগগে প্রথমে দামি বস্তুগুলিকে লুঠে নেওয়ার পরে ধর্মীয় প্রতীক, লেখ, বই ও ঐতিহ্য বহন করে এমন চিহ্নগুলিকে আগুনে ফেলা হয়, তারপর মূলত আগুন লাগানো হয় সিনাগগগুলিতে, নয়তো গুঁড়িয়ে মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হয়। ঝনঝনিয়ে কাঁচ ভেঙে পড়া সেই দু’রাত্তির ধরে জার্মানি,অস্ট্রিয়া আর সুদেতানল্যান্ডে মোট ২৬৭টি সিনাগগ ধ্বংস করা হয়েছিল। এর মধ্যে বেশ ক’টি ছিল ইতিহাসপ্রাচীন। নাৎসি সরকার এই ধ্বংসের শেষ চিহ্নটুকুকেও মুছে ফেলতে তৎপর হয়ে উঠেছিল। আর সেই ধ্বংসস্তূপ সাফসুতরো করার জন্য এক বিলিয়ন রেইখ্শমার্ক অর্থদন্ড ইহুদি নাগরিকদেরই ঘাড়ে চাপানো হয়!
সেই কবে থেকে পৃথিবীর দেশে দেশে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে পদদলিত করার হাতিয়ার হিসাবে ধর্মীয় উপাসনাস্থলের উপর আক্রমণকে জায়েজ করা হয়েছে। কারণটা সহজবোধ্য। মসজিদ বা সিনাগগ, একটি দেশে সংখ্যালঘু মানুষের কাছে শুধু ধর্মবিশ্বাস জাহির করার কেন্দ্র নয়, আত্মপরিচয়ের অস্তিত্বের প্রতীক। তাই তাকে ভাঙা মানে সেই প্রতীককে ভাঙা। তাকে পোড়ানো মানে সেই আত্মপরিচয়কে দুমড়ে মুচড়ে দেওয়া। এটা আধিপত্যবাদের শক্তি জাহির করার একটা মনস্তত্ত্বও বটে। “তুমি যাকে পরম শক্তিমান ভাবো, দ্যাখো আমাদের শক্তির সামনে সে কতো অসহায়” – এই ভাবে শারীরিক হত্যা না করেও সংখ্যালঘুকে ভিতরে ভিতরে গুঁড়িয়ে দেওয়ার, পুড়িয়ে দেওয়ার মনস্তত্ত্ব। বাবরি মসজিদ ভাঙা আর ক্রিস্তালনখট – কোনোটাই তাই বিচ্ছিন্ন দেশজ ঘটনা নয়।
অযোধ্যার রায় ফিরিয়ে দিল ৬ ডিসেম্বর, ১৯৯২-এর সেই দুঃস্বপ্নের আওয়াজ। করসেবকদের “রাম কে নাম মস্ত হ্যায়! বাবরি ধাঁচা ধ্বস্ত হ্যায়” হিংস্র চিৎকারের সঙ্গে এক ইতিহাস প্রাচীন মসজিদের ইঁট খসে পড়ার আওয়াজ। ৯ নভেম্বর তারিখটা সেই আওয়াজের সাথে মিলিয়ে দিল আট দশক আগের সারা রাত ধরে, সারা শহর জুড়ে কাঁচ ভেঙে পড়ার ঝনঝনানি। ইতিহাস পুনরাবৃত্ত হয়? হেগেল বলেছিলেন, হয়। কার্ল মার্ক্স্ বললেন, তা হয় বটে, কিন্তু হেগেল একটা কথা বলতে ভুলে গেছেন! প্রথমবার ইতিহাস ফেরৎ আসে বিয়োগান্তক নাটকের চেহারায়, দ্বিতীয়বার – প্রহসন হিসাবে। অ্যাডল্ফ হিটলারের জায়গায় নরেন্দ্র মোদী আর ইহুদি-কমিউনিস্টদের জায়গায় মুসলিম-মাওয়িস্ট, এই অবধি না হয় আমরা মনে রাখলাম। কিন্তু তারপর? লালফৌজ বার্লিনে ঢুকে এলে পরম শক্তিমান হিটলারের কী পরিণতি হয়েছিল, নরেন্দ্র মোদী তা মনে রাখছেন তো?