Home সেদিন সেই ‘দশ দিন’-এর ১০০ বছর (জন রীডের ‘দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন’ প্রকাশের শতবর্ষে)
2

সেই ‘দশ দিন’-এর ১০০ বছর (জন রীডের ‘দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন’ প্রকাশের শতবর্ষে)

সেই ‘দশ  দিন’-এর ১০০ বছর (জন রীডের ‘দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন’ প্রকাশের শতবর্ষে)
2
শুদ্ধব্রত দেব

“ম্যাক্স, কাউকে বলো না আমি কোথায় আছি। আমি রাশিয়ার বিপ্লবকে ধরতে চাইছি একটা বইয়ে। আমার ছোট্ট ঘরটাতে এখন ইশতেহার আর কাগজের পাহাড়, আর একটা রাশিয়ান ডিকশনারি, আমি দিন রাত এক করে শুধু লিখে চলেছি। গত ৩৬ ঘন্টা আমি দু’চোখের পাতা এক করিনি। দু’সপ্তাহের মধ্যে আমি পুরো ব্যাপারটা শেষ করবই। একটা নামও মাথায় এসেছে – দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন! বিদায় বন্ধু। একটা কফি খাওয়া খুব দরকার। দোহাই তোমাকে, আমি কোথায় আছি কাউকে বলো না।”  – ‘মাসেস’ পত্রিকা সম্পাদক ম্যাক্স ইস্টম্যানকে বলছিলেন ঝোড়ো, ক্লান্ত চেহারার জন রীড, ১৯১৯এর এক বিকেলে। তার কিছুদিনের মধ্যেই, কথামতো, তিনি সম্পূর্ণ করবেন বইটি, ‘টেন ডেজ দ্যাট শুক দ্য ওয়ার্ল্ড’ নামে প্রকাশিত হয়ে যেটি নিজেই দুনিয়া কাঁপিয়ে তুলবে। এই বছর সে বইটির বয়স ১০০ পুরোল।



‘বিশিষ্ট মার্কিন সাংবাদিক’ বললে জন রীড-এর পরিচয় মোটেই বোঝা যায় না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পোর্টল্যান্ডে জন্ম তাঁর, সেই  বন্দর শহরে, যেখানকার শ্রমিকরাই প্রথম রাশিয়ার শ্বেত কলচাক বাহিনীর জন্য জাহাজে গোলা বারুদ বোঝাই করতে অস্বীকার করেছিলেন। লুঠেরা বড়লোকদের প্রতি এক বুক ঘৃণা, প্রতিবাদ আর মাথা না নোয়ানোর সাহসটুকুকে বাদ দিলে জনের বাবা তার জন্যে আর তেমন কিছুই রেখে যেতে পারেননি। পোর্টল্যান্ডের ইশকুলের পাট চুকিয়ে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়ে জন রীড যখন আভিজাত্য আর উন্নাসিকতার সদর দফতরেই বানিয়ে বসলেন ‘সমাজতান্ত্রিক ক্লাব’, পরমজ্ঞানী অধ্যাপকেরা ভেবেছিলেন বিপ্লবের ও ভূত দু’দিন বাদেই ঘাড় থেকে নেমে যাবে। বোঝেননি তাঁরা যে ওই ভূতই মেধাবী ছাত্রটিকে একদিন দুনিয়া ভরে দৌড় করাবে, আর কমিউনিজমের সেই ভূতটাকে তার লেখায় আবিষ্কার করে চমকে চমকে উঠবে পশ্চিমী দুনিয়া। ছাত্র থাকার সময়েই ‘ল্যাম্পুন’ পত্রিকায় তাঁর লেখালিখি নাম কুড়িয়েছিল বেশ, বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌহদ্দি পেরোনোর আগেই তাঁর কাছে বিবিধ পত্রপত্রিকায় লেখার আমন্ত্রণ। সে থেকে শুরু। খবর খুঁজতে গিয়ে কখন যে তিনি মানুষের নদীর পারে এসে দাঁড়ালেন, তা বোধহয় তাঁর নিজেরও মনে পড়ত না। জনের জীবনীকার ও অভিন্নহৃদয় বন্ধু, আর এক বামপন্থী সাংবাদিক আলবার্ট রিস উইলিয়াম সবচেয়ে ভালো ধরতে পেরেছিলেন তাঁকে। রিসের কথায় “সমকালীন ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে যদি কেউ ওয়াকিফহাল থাকতে চান তাহলে তার শুধু জন রীডকে অনুসরণ করলেই চলে। ঝড়ের পাখি আলবাট্রসের মতো যেখানে ইঙ্গিতবাহী কিছু, সেখানেই জন রীড।”সত্যিই তাই।কলোরাডোয় মার্কিন ধনকুবের রকফেলারের খনিশ্রমিকদের বিদ্রোহ বা প্যাটারসনের সূতাকল শ্রমিকদের ধর্মঘট, কি সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের কামানগর্জন – জন রীড সর্বত্রগামী। জার্মানিতে, তুরস্কে, ইতালিতে, ফ্রান্সে…। গ্রেফতার হন, বেরিয়ে এসেই আবার ঝাঁপিয়ে পড়েন ঘটনার ঝঞ্ঝাবর্তে! মেক্সিকোতে ঋণবন্দি (‘পওন’) ভূমিপুত্র কৃষকেরা পঞ্চো ভিলার নেতৃত্বে বিদ্রোহের নিশান উড়িয়ে রাজধানীর দিকে রওয়ানা দিলে সেই কাতারেও দেখি অশ্বারোহী জন রীডকে। এবং আমরা হাতে পেলাম ‘ইনসার্জেন্ট মেক্সিকো’র মতো প্রামাণ্য একটি বই।

আইজেনস্টাইনের চলচ্চিত্রে লেনিন



বুর্জোয়া পত্রপত্রিকায় রীডের লেখার চাহিদা ছিল নেহাত কম নয়। কিন্তু তাঁর শ্রেষ্ঠ লেখাগুলি পেত লিবারেটর-এর মতো বামপন্থী পত্রিকা, একেবারে বিনামূল্যে! এই পত্রিকাতেই বেরিয়েছিল তাঁর বিখ্যাত সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধবিরোধী নিবন্ধ “Get a straight jacket for your soldier son” – যা তাকে রাষ্ট্রদ্রোহের দায়ে অভিযুক্ত করে। ভয় পাননি তিনি। বরং আদালতে দাঁড়িয়ে আমেরিকার হয়ে যুদ্ধে যেতে সরাসরি অস্বীকার করে যুক্তিবাদী আর আবেগপ্রবণ এক যুদ্ধবিরোধী ভাষণে নড়ে বসতে বাধ্য করেছিলেন জুরিদের। লিখতেনই না তিনি শুধু। লেখার জন্য অনুসন্ধানে গিয়ে পাওয়া সত্যিগুলিকে মানুষের সামনে তুলে ধরার জন্য সভা, আলোচনাসভা। রকফেলার থেকে রাষ্ট্র, কাউকে রেয়াত না করে।

দেখুন: স্তালিনের পাহারাদার সেই মানুষটি, ভিডিও

আর তারপর সেই দুনিয়া কাঁপানো বই! ১৯১৭-র গ্রীষ্ম থেকে শীতকাল, রাশিয়ার বাতাসে বেড়ে ওঠা উত্তাপ থেকে শীতপ্রাসাদের পতন অবধি পৃথিবীর প্রথম প্রলেতারীয় বিপ্লবের সরেজমিন সাক্ষী রইলেন লাগাতার, বিপ্লবী জনতার সাথে কাঁধে কাঁধ রেখে। সেই বিপ্লবের বার্তা মনে গেঁথে আর স্যুটকেস বই আর ইশতেহারে ভরে নিউইয়র্ক ফিরেই তিনি রাষ্ট্রের আক্রমণের মুখে পড়লেন। নিউইয়র্কের এক ছোট্ট কুঠুরিতে বসে কী ভাবে শেষ করেছিলেন এই বইটি, শুরুতে ম্যাক্সকে বলা তাঁর নিজের কথায় কিছুটা আন্দাজ করা যায়। একসময় যে সব পুঁজিবাদী সংবাদপত্রের কাছে তিনি ছিলেন নক্ষত্র লেখক, তারাই বন্ধ করে দিল তাঁর লেখা ছাপা, গালাগালি আর কুৎসার বন্যায় ভাসিয়ে দিতে চাইল তাঁকে। কিন্তু জন রীড ততদিনে পেয়ে গেছেন আরও বড়ো মঞ্চ – জনতার মাঝে সভা করে তিনি ছড়িয়ে চললেন এক অজানি দেশের না জানি কী বিপ্লবের খবর। সারা পৃথিবী জন রীডের Ten days That Shook The World বইটি থেকে জানল রুশ বিপ্লবের কথা, বলশেভিকদের কথা, লেনিন নামের সেই মানুষটির কথা। অপারেশনে একটি কিডনি খোওয়ালে ডাক্তার যখন তাঁকে যুদ্ধের জন্য অনুপযুক্ত ঘোষণা করেন, তখন জন রীডের প্রতিক্রিয়া ছিল “দুই জাতির মধ্যেকার যুদ্ধ থেকে রেহাই মিলল বটে, কিন্তু শ্রেণিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার দায় থেকে তো ছুটি নেই”। কিন্তু এই বইটি বেরোনোর মাত্র একবছরের মধ্যেই জন রীড মারা যান। ১৯২০-র ১৭ অক্টোবর। মস্কোতেই। মৃত্যুর পরে পেয়েছিলেন বীরের মর্যাদা। কিন্তু জীবিত অবস্থাতেই তিনি পেয়ে গিয়েছিলেন তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার – Ten days That Shook The World বইটিতে ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের নিজের হাতে লিখে দেওয়া ভূমিকা!

জন রীড



লেনিন চেয়েছিলেন বইটি কোটি কোটি সংখ্যায় ছাপা হোক, দুনিয়ার সব ভাষায় অনূদিত হোক। ভাবতে ভালো লাগে, ১০০ বছর পেরিয়েও বিপ্লবের স্বপ্ন দেখা কোনো কিশোর কমিক্স বই ফেলে বা পোড় খাওয়া কোনও শ্রমিক শিফট শেষ করে এসে উজ্জীবিত হচ্ছে দুনিয়া কাঁপানো সেই দশটি দিনের গাথায়:                
“মজুরদের মাঝে মাঝে সৈনিকেরাও আসছিল তাদের কফিন নিয়ে, আসছিল ঘোড়সওয়ার স্কোয়াড্রন, স্যালুটের কুচকাওয়াজ করে, ছিল গোলন্দাজ ব্যাটারি, কামান তাদের লাল আর কালো কাপড়ে মোড়া, বুঝি-বা চিরকালের মতোই। ঝান্ডায় লেখাঃ ‘তৃতীয় আন্তর্জাতিক জিন্দাবাদ!’, ‘চাই ন্যায্য, গণতান্ত্রিক, সর্বাত্মক শান্তি!’
ধীরে ধীরে কফিন নিয়ে শোভাযাত্রীরা এসে পৌঁছাল সমাধির কাছে, বোঝা নিয়ে ঢিবির ওপর উঠে নেমে এল গর্তে। অনেকেই তাদের নারী – শক্তসমর্থ, গাঁট্টাগোঁট্টা প্রলেতারীয় নারী। মৃতের পেছন পেছন এল আরও নারী – ভেঙে-পড়া তরুণী যুবতী, নয়তো বলিরেখাচ্ছন্ন বৃদ্ধা, আহত পশুর মতো আর্তনাদ করছে, পতিপুত্রের অনুগমন করছে ভ্রাতৃ-সমাধিতে, প্রবোধ দিয়ে কোনো হাত তাদের সংযত করতে গেলেই ডুকরে উঠছে তারস্বরে। পরস্পরকে কী ভালোই না বাসে গরিবরা।
সারা দিন ধরে চলল অন্তিম মিছিল, এল তারা ইবেরিয়ান ফটক দিয়ে, চলে গেল নিকোলস্কায়া পেরিয়ে, লাল পতাকার একনদী স্রোত বহন করে চলল আশা আর ভ্রাতৃত্ব, বিপুল এক ভবিষ্যতের বাণী, পঞ্চাশ হাজার জনতার এক পটভূমির সামনে দিয়ে, বিশ্বের সমস্ত শ্রমিকজন ও তাদের অনন্ত বংশধরদের দৃষ্টির তলে…
একের পর এক পাঁচশ’ কফিন নামল গর্তে। নামল প্রদোষ। তখনো বিরাম নেই অবনত আন্দোলিত পতাকার। ব্যান্ডে বাজল অন্ত্যেষ্টি সঙ্গীত। বিশাল জনতার সুর জাগল। সমাধির ওপর গাছগুলোর নিষ্পত্র শাখায় টাঙানো রাশি রাশি মালাগুলো যেন বিচিত্র কোন সাতরঙা ফুল। দুশ’ লোক কোদাল চালাতে লাগল মাটির স্তূপে। ঝুপ ঝুপ করে তা ঝরে পড়ার শব্দ উঠল সঙ্গীতের ফাঁকে ফাঁকে…

আলো জ্বলল। পেরিয়ে গেল শেষ পতাকা, শেষ শোকার্তা নারী, ফিরে চেয়ে গেল এক বুক ভাঙা তীব্রতায়। বিরাট ময়দান থেকে ধীরে ধীরে ফিরে ভাটায় নামল প্রলেতারীয় জোয়ার…

হঠাৎ অনুভব করলাম, স্বর্গে পৌঁছবার জন্য ধর্মপ্রাণ রুশীদের আর পুরোহিতের প্রয়োজন নেই। মর্ত্যে তারা যে-রাজ্য গড়তে শুরু করেছে তা কোনো স্বর্গেও পাবার নয়। তার জন্য মৃত্যু বরণ গৌরবের কথা……”।

Share Now:

Comment(2)

LEAVE YOUR COMMENT

Your email address will not be published. Required fields are marked *